আগুনে পুড়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের সনদ, স্বীকৃতি পাননি ৯৭ বছরের শাহজাহান

১৯৭১ সালে নলছিটি-রাজাপুর-পিরোজপুর অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার বৈচন্ডী গ্রামের শাহজাহান হাওলাদার। স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়ে যাওয়া এই যোদ্ধা আজ ৯৭ বছর বয়সে এসে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। আগুনে পুড়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সনদ তাকে এখনো সেই সম্মান থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর, কাঁপা কণ্ঠ তবুও ৫৪ বছর আগের যুদ্ধের স্মৃতিগুলো তার কাছে এখনো যেন একেবারে নতুন। পাক হানাদারদের তাণ্ডব, সহযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, গ্রাম রক্ষার লড়াই সবকিছুই তিনি এখনও স্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন।
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার বৈচন্ডী গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান হাওলাদার পেশায় ছিলেন কৃষক। শান্ত, নির্লোভ ও সৎ চরিত্রের জন্য এলাকায় তিনি সবার কাছে শ্রদ্ধেয় ছিলেন। সমাজসেবা ও উন্নয়নমূলক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এক সময় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮। তবে তিনি ও তার পরিবার দাবি করেন, তার প্রকৃত জন্ম ১৯২৯ সালে। নিজের হিসাবেও তিনি প্রায় এক শতাব্দীর জীবনের পথ অতিক্রম করেছেন বলে জানান।
শাহজাহান হাওলাদার বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে নলছিটি ও রাজাপুরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তিনি সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেন। রাজাপুর ফাঁড়ি আক্রমণ, নলছিটির বিভিন্ন গ্রাম রক্ষা, হানাদার বাহিনীর টহল ও অবস্থানে প্রতিরোধ এমন অসংখ্য অভিযানে অংশ নিয়েছেন তিনি। শত্রুর গতিবিধি সংগ্রহ, অস্ত্র সরবরাহ, গেরিলা আক্রমণসহ ঝুঁকিপূর্ণ নানা দায়িত্ব পালন করেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তার জীবনের সংগ্রাম থামেনি। ১৯৮৭ সালে পারিবারিক কলহে নিহত হন তার প্রথম স্ত্রী। সেই সময়েই ঘটে আরেক ভয়াবহ ঘটনা তাদের ঘরে আগুন লাগে এবং পুড়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের সব কাগজপত্র, সনদ, সুপারিশপত্র ও দলিলাদি। সেই আগুনই প্রায় বন্ধ করে দেয় তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পথ। যেসব প্রমাণের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করা হয় সবই ছিল সেই ঘরে। আগুনের ছাই থেকে আর কিছুই উদ্ধার সম্ভব হয়নি।
কাগজপত্র হারানোর পর বছরের পর বছর তিনি বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেছেন। নলছিটি থেকে ঝালকাঠি, ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় প্রমাণ যাচাইয়ের জন্য অসংখ্যবার ছুটে বেড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জেলা কমান্ডারের সহযোগিতায় ঢাকায় গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ করেন। এরপর আর সেই দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যেতে পারেননি।
তার বড় ছেলে মো. শহীদ হাওলাদার বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকেই বাবার যুদ্ধের গল্প শুনেছি। ১৯৮৭ সালের আগুনে সব কাগজপত্র নষ্ট হওয়ার পর আমাদের হাতে আর কোনো প্রমাণ নেই। তবে বাবার সহযোদ্ধারা আজও স্বীকার করেন তিনি মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন।
নলছিটি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. বাকে আলী কাজী বলেন, শাহজাহান হাওলাদার আমার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তার কাগজ হারিয়ে গেছে, এটা আমি জানি। তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তালিকায় নাম তোলার প্রক্রিয়া আর শেষ হয়নি। বর্তমানে দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে দেখাশোনা করছেন। প্রায় শতবর্ষী এই মানুষটি এখন চোখে ঠিকমতো দেখতে পান না, হাঁটতেও কষ্ট হয়। তবুও তার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দৃশ্য এখনও জীবন্ত।
এক সময় হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন রক্ষা করেছিলেন যে মানুষটি তার আজ একটাই শেষ আশা, মৃত্যুর আগে যেন রাষ্ট্র আমাকে একজন স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিনে। শাহজাহান হাওলাদারের দীর্ঘ অপেক্ষা, কষ্ট, সংগ্রাম ও সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধার জীবনগল্প আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রত্যাশায় ঝুলে আছে।
শাহীন আলম/এআরবি