দৃষ্টিহীন চোখে সংসারের ভার, হার মানেননি আব্দুল মান্নান

জীবনযুদ্ধে হার না মানা ব্যক্তি ষাটোর্ধ্ব আব্দুল মান্নান। দৃষ্টিহীন চোখ নিয়েও তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অন্ধ হলেও তার লড়াই থেমে নেই- গাভীর দুধ বিক্রি থেকে পাওয়া সামান্য আয় এবং সরকারিভাবে তিন মাস পর পর পাওয়া ২ হাজার ৬শ টাকার ভাতায় চলে তার চার সদস্যের সংসার।
মাত্র সাত বছর বয়সে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান তিনি। বহুবার ঢাকা শহরের চিকিৎসা করেও ফেরেনি তার চোখের আলো। নিয়তির নির্মম পরিহাস, এক সময় যার পরিবার অন্যের সাহায্য সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দিতো, সেই পরিবারের মান্নানের আজকে মানবেতর জীবনযাপন নিত্য দিনের সঙ্গী। তবুও জীবনের কাছে হার না মেনে কর্ম করেই সংসারের জীবিকা নির্বাহ করে চলছেন তিনি।
মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায় ধল্লা ইউনিয়নের মেদুলিয়া গ্রামের ৬২ বছরের অন্ধ আব্দুল মান্নানের জীবনের গল্পের কথা। মাত্র ২৪ বছর বয়সে স্থানীয় খাদেজা বেগমকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন মান্নান। এখন তাদের পরিবারের চারজন সদস্য তিনি, তার স্ত্রী, তালাকপ্রাপ্ত মেয়ে এবং ছোট্ট নাতনি।

একমাত্র মেয়েকে সুখী করতে বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু স্বামী বঞ্ছনায় বিবাহ বিচ্ছেদের পর বাবার সংসারেই ফিরে আসে মেয়ে। নাতনি স্থানীয় একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, কিন্তু অভাবের সংসারের নাতনির পড়াশোনার খরচও জোগাতে হিমশিম খেতে হয় মান্নানের।
আব্দুল মান্নান ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকে বলেন, মাত্র দেড় শতক জায়গায় ছোট্ট একটি ঘর, সেই ঘরেই আমাদের বসবাস। আমার উপার্জনের কোনো উৎসও নেই, তবুও অন্ধ চোখে গবাদি পশুর (গাভী) ঘাস কাটা, গাভীর দুধ দোহানো, খড়-কুটা, ভূসি খাওয়ানো সবই নিজেই করি। প্রতিদিনের জীবনের সংগ্রাম আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।
মান্নান বলেন, নিজের লালন-পালন করা গবাদি পশু (গাভী) থেকে দৈনিক দেড় থেকে দুই কেজি দুধ বিক্রির টাকা, আর সরকারিভাবে তিন মাস পর পর প্রতিবন্ধী ভাতা ২ হাজার ৬০০ টাকা পাই। এ দিয়েই কোনো মতে সংসারের খরচ চালাই। এটাই আমার পরিবারের একমাত্র আয়েল উৎস, কিন্তু এই সময়ে এই টাকায় চার সদস্যের সংসারের খরচ মেটানো খুবই কষ্টসাধ্য বিষয়। কখনও কারও কাছে তো হাত পাতি নাই, এভাবেই কষ্ট হলেও জীবন-যাপন করছি। নিজের তেমন টাকা পয়সাও নাই, যে অন্য কিছু করব।
মান্নানের মা বলেন, ‘ওর বাবার তো ধন-সম্পত্তিও নাই, টাকা পয়সাও নাই, যে অন্য কিছু করব। খুব কষ্ট করে আমার ছেলেটা সংসার চালায়। চোখে দেখে না, তারপরও এই কাজ করে যাচ্ছে। শেষ বয়সে এসে চোখের সামনে নিজের ছেলের এমন দুবির্ষহ জীবন দেখে খুব কষ্ট পাই। কিন্তু আমিও তো তার জন্য কিছু করতে পারছি না, নিজেরও বয়স অনেক হইছে। সরকারিভাবে বা সমাজের বিত্তশালীরা যদি মান্নানকে সাহায্য সহযোগিতা করতো তাহলে ছেলেটার কষ্ট কিছুটা হলেও কমতো।

স্থানীয়রা জানান, ছোট বেলায় মান্নানের চোখের আলো চলে যায়। তারপর থেকে সংগ্রাম করেই জীবন-যাপন করছেন। মাঝে মধ্যে স্থানীয়রা সামান্য সহযোগিতা করেন, আর সরকারিভাবে সামান্য ভাতার টাকা পান। সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা পেলে অন্ধ মান্নানের জীবন কিছুটা হলেও সহজ হতে পারত। তারা আশা করেন, সামজের সামর্থ্যবান মানুষ কিংবা প্রশাসন এগিয়ে আসবে এই আলোহীন মানুষের পাশে।
সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খায়রুন নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপনার মাধ্যমে অন্ধ আব্দুল মান্নানের বিষয়টি জানতে পারলাম। তার বিষয়ে খোঁজ খবর নিবো এবং তিনি সত্যি অসহায় হলে আমাদের বরাবর আবেদন করলে সেট বিবেচনায় রেখে সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হবে বলে তিনি জানান।
সোহেল হোসেন/আরকে