অনিশ্চয়তার আঁধারে নতুন আলোর খোঁজ দিচ্ছে আই-ফার্মার

ভোরের আলো ফোটার আগেই দেশের গ্রামগুলোতে শুরু হয় কৃষকের কর্মযজ্ঞ। কেউ জমিতে কোদাল ধরেন, কেউবা লাঙল, আবার কেউ বীজ ছেটাতে ব্যস্ত। কেউবা সেচ দেন জমিতে, কেউ সার ও কীটনাশক ছেটান। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে যারা দেশের মানুষের অন্নের জোগান দেন, তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাঝে জীবনের গল্পের আড়ালে প্রায়শই লুকিয়ে থাকে গভীর অনিশ্চয়তা।
ফসল উৎপাদনের ঝুঁকি তো আছেই, তার ওপরে রয়েছে ব্যক্তিগত জীবনে নেমে আসা অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের শঙ্কা। অসুখ, দুর্ঘটনা কিংবা অকালমৃত্যু—যেকোনো সময় এই পরিশ্রমী মানুষগুলোর সাজানো সংসার তছনছ করে দিতে পারে। পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস বন্ধ হয়ে গেলে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। ঋণের বোঝা তখন পাহাড়সম মনে হয়। কৃষকের এই ঝুঁকি ও অসহায়ত্ব ঘোচাতে এবং তাদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় কৃষি-প্রযুক্তি (অ্যাগ্রি-টেক) প্রতিষ্ঠান ‘আই-ফার্মার’।
দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এবং গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে অংশীদারিত্বে বিশেষ এক বীমা কাঠামো চালু করেছে। কেবল ফসলের উৎপাদন বাড়াতেই নয়, বরং কৃষকের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও কাজ করে যাচ্ছে। কৃষকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এখানে দুটি প্রধান সুবিধা রাখা হয়েছে—একটি হলো ঋণ সুরক্ষা বীমা এবং অন্যটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা বীমা। এই দ্বৈত সুরক্ষা কৃষকদের জন্য একটি মজবুত আর্থিক ভিত্তি তৈরি করেছে।
ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি
ঋণ সুরক্ষা বীমার আওতায় কোনো কৃষক যদি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মৃত্যুবরণ করেন কিংবা স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন, তবে তার পরিবারকে আর ঋণের বোঝা টানতে হয় না। এই বীমা সুবিধার মাধ্যমে কৃষকের অবশিষ্ট ঋণের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়। এটি নিশ্চিত করে যে, পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অনুপস্থিতি বা অক্ষমতার কারণে পরিবারটিকে নতুন করে আর্থিক সংকটে পড়তে হবে না। এমনকি কৃষকের পরিবারের তাৎক্ষণিক আর্থিক সংকট মেটাতেও নগদ সহায়তা প্রদান করা হয়। এই সহায়তা দুঃসময়ে পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ।
এই সুবিধার বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যায় নওগাঁ সদরের মোশেরপুর এলাকার বাসিন্দা মোছা. গোলাপী বেগমের পরিবারে। পোল্ট্রি প্রকল্পের জন্য তিনি ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ঋণ শোধের আগেই চলতি বছরের ৪ অক্টোবর হঠাৎ স্ট্রোক করে তিনি মারা যান।
মরহুমা গোলাপী বেগমের স্বামী নাজমুল হক আই-ফার্মার’র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমার স্ত্রী আই-ফার্মার থেকে ঋণ নিয়েছিল। হঠাৎ মারা যাওয়ার পর তারা পুরো ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে। তাছাড়া স্ত্রীর দাফন-কাফনের জন্য আরও ১০ হাজার টাকা দিয়েছে। অন্য সমিতির তুলনায় এই আই-ফার্মার সুবিধা আমার কাছে ভালো লেগেছে। এখানে কোনো সঞ্চয় রাখতে হয়নি, ঋণের জন্যও কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি।
চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন
অন্যদিকে কৃষকের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে চালু করা হয়েছে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা বীমা’। একজন কৃষক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয় এই বীমার মাধ্যমে বহন করা হয়। শুধু তাই নয়, চিকিৎসকের পরামর্শ ফি, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণের খরচও এখান থেকে পাওয়া যায়। এতে করে চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে কৃষক পরিবারকে আর শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করতে হয় না বা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না।
বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার চেংগাপাচপুকুরিয়া এলাকার গ্রাহক আবু হানিফ বলেন, আমি প্রথমবার ধানের ওপর ৫০ হাজার টাকা লোন নিয়েছিলাম, যা ছয় মাস পর শোধ করেছি। পরে আবার ৫০ হাজার টাকা আলুর ওপর লোন নিয়েছি। আই-ফার্মার থেকে লোন নেওয়া অন্যান্য সমিতির তুলনায় সুবিধাজনক। এখানে কোনো চাপ থাকে না। লোন নিলাম, আবার শোধ করলাম। আর আমি স্বাস্থ্য বীমা করেছি। তারা আমাকে এক বছরের মেয়াদের একটি কার্ড দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কোনো অসুখ, দুর্ঘটনা বা শরীরের সমস্যা হলে তারা সহযোগিতা করবে।
ব্যাপক সাড়া এবং সহজ পদ্ধতি
উদ্যোগটি শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক সাড়া মিলেছে। ইতোমধ্যেই পনেরো হাজারের বেশি কৃষক এই সুরক্ষার আওতায় এসেছেন। এখন পর্যন্ত আটাশটি বীমা দাবি নিষ্পত্তি করা হয়েছে, এই সহায়তাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়, বরং বিপদগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে কাজ করছে।
একই উপজেলার আতাইল গ্রামের কৃষক আল-আমিন বলেন, আই-ফার্মার কৃষকদের জন্য খুব ভালো। কেননা অন্য এনজিও বা সমিতিতে গেলে সঞ্চয় রাখতে হয়, মাসিক একটি ডিপিএস খুলতে হয়। কিন্তু এখানে এটি দেওয়া লাগে না। শুধু একবার ফি দিয়ে সদস্য হয়ে যত টাকা লোন নিব, তার ওপর আবেদন করলেই টাকা পাওয়া যায়। আবার লোনের মেয়াদের উপর একটা লাভ দিয়ে পরিশোধ করতে হয়।
তিনি আরও জানান, কৃষকদের জন্য তাদের স্বাস্থ্য বীমাও আছে, যা তিনি করেছেন। এক বছরের মধ্যে আমার কিছু হলে তারা পাশে দাঁড়াবে, যোগ করেন এই কৃষক।
এ বিষয়ে আই-ফার্মার’র হেড অফ নিউ বিজনেস অপারচুনিটিজ মোহাম্মদ ইখতিয়ার সোবহান বলেন, “বীমা নিয়ে মানুষের, বিশেষ করে কৃষকদের মাঝে যে নেতিবাচক ধারণা কাজ করে সেগুলি নিয়ে আমরা আমাদের সহযোগী বীমা কোম্পানীদের নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। বীমা সুবিধা দাবি করার জটিলতা, ক্ষতিপূরণ পেতে দেরি হওয়া ইত্যাদি সমস্যাগুলো অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছি যদিও আরও উন্নতির জায়গা আছে। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট সবপক্ষ এগিয়ে এলে কৃষকরা, যাদের সত্যিকারে বীমা সুরক্ষা দরকার তারা সেই সুবিধা পুরোপুরি পাবেন।”
কৃষকের জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা দূর করে তাদের আত্মবিশ্বাস ও স্থিতিশীলতা দিতে আই-ফার্মার’র এই দ্বৈত বীমা কাঠামো দেশের কৃষিখাতে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, প্রযুক্তির সহায়তায় কৃষকদের পাশে দাঁড়ালে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।
আরকে