যাত্রীবাহী লঞ্চের সংঘর্ষ : নিহতদের বাড়িতে শোকের মাতম

চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে বরিশালের ‘অ্যাডভেঞ্চার-৯’ ও ভোলার ‘জাকির সম্রাট-৩’ নামে দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চের সংঘর্ষে চার যাত্রী নিহত হয়েছেন। নিহতদের সবার বাড়ি ভোলার লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলায়। স্বজনদের গগনবিদারী আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার আকাশ-বাতাস। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো।
নিহতরা হলেন—ভোলার লালমোহন উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাজীরাবাদ গ্রামের সেরাজুল হকের ছেলে আব্দুল গনি (৩৫), একই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কালু খাঁনের ছেলে মো. সাজু (৪৭), গজারিয়া ইউনিয়নের কচুয়াখালী গ্রামের মো. মিলনের স্ত্রী রিনা আক্তার (৩৫) এবং চরফ্যাশন উপজেলার আহম্মেদপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ফরিদাবাদ গ্রামের মো. হানিফ (৬০)।
নিহত গনি ও সাজুর বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, তারা সবাই ছিলেন নিম্নবিত্ত ও পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে চরফ্যাশনের ঘোষেরহাট থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে এমভি জাকির সম্রাট-৩। পথে বোরহানউদ্দিনের দেউলা ঘাট থেকে আরও যাত্রী নিয়ে ফের রওনা হয় লঞ্চটি। নিহতরা সবাই ছিলেন লঞ্চের ডেকের যাত্রী।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে লঞ্চটি চাঁদপুরের হরিণা এলাকায় পৌঁছালে ঘন কুয়াশার কবলে পড়ে। এ সময় গতি কমিয়ে ঢাকার দিকে যাওয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা বরিশাল-ঝালকাঠিগামী দ্রুতগতির এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চটি জাকির সম্রাটকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে জাকির সম্রাটের এক পাশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চটিতে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা চার যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হন এবং আরও কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
নিহত রাজমিস্ত্রি আব্দুল গনি দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক ছিলেন। অভাবের সংসারে ঋণের টাকা পরিশোধের আশায় ঢাকা যাচ্ছিলেন তিনি। তার বৃদ্ধ মা শাহানুর বেগম বিলাপ করে বলেন, ‘কে মা কইয়া ডাক দিবো? আমি কারে বাবা বোলাউম গো! আমার তিনডা নাতি-নাতিনরে কেডায় চাইবো?’
মাটিতে গড়াগড়ি করে বিলাপ করছিলেন গনির স্ত্রী। তিনি বলেন, ‘দেনা কইরা টিন দিয়া ঘর তুলছি। সেই ঋণ শোধ করতে ১০ দিন আগে বাড়ি থাইকা গেছিল। মধ্যরাতে খবর পাইলাম আমার স্বামী আর নাই। এখন আমার সন্তানদের কে খাওয়াইবো?’ গনির ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া বড় মেয়ে জানায়, "আমার আব্বারে হত্যা করা হয়েছে, আমরা বিচার চাই।’
একই ইউনিয়নের মো. সাজুর বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘স্বামী কৃষিকাজ করতেন। ধারদেনা করে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সেই আসবাবপত্র দেওয়ার টাকা জোগাড় করতে দিনমজুরের কাজে ঢাকা যাচ্ছিলেন তিনি। আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
নিহত সাজুর ভাই কাসেম ও জামাতা খোকন অভিযোগ করে বলেন, ‘এটি একটি হত্যাকাণ্ড। আমরা এর বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাই। নৌপথকে নিরাপদ করতে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা চাই না আর কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি হোক।
এ বিষয়ে ভোলার জেলা প্রশাসক ডা. শামীম রহমান বলেন, নিহতদের পরিবারকে সরকারিভাবে সহায়তা করা হবে। লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহ আজিজ তিনজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নিহতদের মরদেহ শনিবার ভোরে নিজ গ্রামে পৌঁছালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে।
খাইরুল ইসলাম/এএমকে