মীরকাদিমের বিখ্যাত ধবল গরু কিনতে যেতে হবে খামারে

কোরবানির ঈদে পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের গনি মিয়ার হাটের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ থাকে মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিমের ধবল (সাদা) গরু। অন্যান্য এলাকা থেকেও লোকজন এখানে আসেন এই গরুর সন্ধানে। অনেক দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যান পুরান ঢাকার খানদানি লোকেরা।
খামারিরা জানান, এই গরু পালনে কোনো রকম ইনজেকশন বা গরু মোটাতাজাকরণের ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। এই গরুকে কোনো ঘাস খাওয়ানো হয় না। খামারিদের নিজস্ব মিলে ভাঙানো খৈল, ভুসি, কুঁড়া, চালের গুঁড়া খাইয়ে পরম মমতায় লালনপালন করা হয় এই গরুগুলোকে। খামারের ভেতরের পরিবেশ বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। বাইরের কাউকে খামারের ভেতর ঢুকতে দেওয়া হয় না।
মিরকাদিমের এই গরুর চোখের পাপড়ি সাদা, নাকের সামনের অংশ সাদা, পায়ের খুর সাদা, লেজের পশম সাদা, আর সারা শরীরও সাদা হয়ে থাকে। এই সাদা গরুগুলো সাধারণত ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দামে হয়ে থাকে। মুন্সিগঞ্জের কোনো হাটে এই গরু বিক্রি হয় না। শুধুমাত্র খামারে এবং পুরান ঢাকার হাটেই বিক্রি হয়ে থাকে। পুরান ঢাকার লোকজন মীরকাদিমে এসেও এ সমস্ত খামারে গিয়ে গরুগুলো ক্রয় করে নিয়ে যান। এ বছর করোনার কারণে খামরিরা তাদের গরু হাটে নয় খামারেই বিক্রি করতে চান।

তবে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার মীরকাদিম পৌরসভার কুলুপাড়ার ধবল গরু লালনপালন করার যে ঐতিহ্য ছিল তা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কালের বিবর্তনে মীরকাদিমের বিখ্যাত ধবল গরুর ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। ভেজালযুক্ত খাবার দিয়ে গরু মোটাতাজা করে দ্রুত আঙল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে কিছু অসাধু খামারি। সেখানে ১০ মাস দীর্ঘ পরিশ্রম করে লাভবান না হওয়ায় এ ব্যবসা থেকে সরে আসছেন মীরকাদিমের ধবল গরু ব্যবসায়ীরা। ভেজাল খাদ্যের যোগান দিয়ে গরু বড় করে দ্রুত লাভবান হওয়ার হাতিয়ারকে এখন কাজে লাগাচ্ছে অনেকেই। ফলে ২০০ জনের বেশি ধবল গরুর খামার মালিক থেকে এখন ১০-১২ জনে নেমে এসেছে।
হাজি গোলাম মোস্তফা এগ্রো ফার্মের মালিক হাজি গোলাম মোস্তফা বলেন, লাভ লোকসানের কথা চিন্তা না করেই পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখে গরু পালন করে আসছি। আমার বাবা-দাদারাও ধবল গরু পালন করতো। আমরা গরুগুলোকে বাহিরের ঘাস খাওয়াই না। আমাদের ধান, গম আর তেলের কারখানা থাকার কারণে মীরকাদিমের ভুসি, কুঁড়াসহ বিভিন্ন উন্নতমানের গোখাদ্য মিনিকেট চালের খুদ, এক নম্বর খৈল, ভাতের মার, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভুসি, গমের ভুসি, বুটের ভুসি খাওয়াই। এছাড়া গরু পালনে প্রশিক্ষিত লোক নিয়োগের মাধ্যমে গরুগুলো পালন করি।
তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে গো খাদ্যের দাম বেশি। আমার খামারে শতাধিক গরু রয়েছে। এর মধ্য ধবল গরু আছে ৪০টির মতো। ধবল ছাড়াও শাইয়াল, নেপালি, ভুটান ও সিন্ধি জাতের গরু রয়েছে।
হাজি গোলাম মোস্তফা বলেন, পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ ও গনি মিয়ার হাটেই আমরা এ সমস্ত গরুগুলো বংশ পরম্পরায় বিক্রি করে আসছি। তবে এখন পুরান ঢাকার লোকজনসহ অন্যান্য এলাকার লোকজন খামারে এসে গরু কিনে নিয়ে যান। আমরা করোনাকালে আমাদের গরুগুলো খামার থেকেই বিক্রি করতে চাই। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গরু বিক্রিও করেছি। আমার খামারে ২ থেকে ১০ লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে।
হাবিব হাজির খামারের শ্রমিক সাদের আলী বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে ধবল গরু লালনপালন করছি। আমি অভিজ্ঞ হওয়ায় মালিক আমাকে ২২ হাজার টাকা বেতন দেন। তবে আগের মতো ঘরে ঘরে মীরকাদিমে কেউ গরু পালন করেন না। আগে রহমতগঞ্জের গনিমিয়ার হাট বলতে মীরকাদিমের গরুকে বোঝাতো। এখন হাতেগোনা কয়েকজন গরু পালন করেন।
তিনি আরও বলেন, মীরকাদিমের ধবল গরু পালনে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। কুড়িগ্রাম জেলার ভূরাঙ্গামারীসহ বিভিন্ন হাট ও এলাকা থেকে ভারত ও ভুটানের আবাল-পশ্চিমা সাদা ষাঁড় ও সাদা গাভীর বাচ্চা কিনে আনেন মীরকাদিমের খামারিরা। নিজের বাচ্চার মতো লালন করেন। নতুন গামছা দিয়ে গোসল করানো হয়। সব সময় চোখে চোখে রাখা হয়।

সাদের আলী বলেন, আমরা গত কোরবানি ঈদের এক সপ্তাহ পর ভূরাঙ্গামারী হাট থেকে এ বছর ২২টি ধবলসহ ভুট্টি, শাইয়াল, নেপালি, ভুটান ও সিন্ধি জাতের ৭০টি গরু কিনে আনি। এক বছর ধরে গরুগুলো লালনপালন করছি। খামারে আস্ত গরু মেপে ৪৪০ টাকা কেজি দরে কিছু গরু বিক্রি করেছি।
খামারিরা জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা গরু কিনে এনে পালন করেন তারা । ছোট ভুট্টি গরু ১০-২০ হাজার টাকায় কিনে এনে ১০-১২ মাস পালন করে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এই গরু বেশি বড় হয় না। দেখতে গোল গাল। আর নেপালি ও ভারতের অন্য প্রজাতির বড় গরু কেনেন প্রায় লাখ টাকায়। ১০-১২ মাস লালনপালন করে বিক্রি করেন ২ থেকে ১০ লাখ টাকা। প্রতি গরুর পেছনে লক্ষাধিক টাকা খরচ হতো।
মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কুমুদ রঞ্জন মিত্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই জেলায় ১২-১৪টি খামারে এখন ধবল গরু পালন করা হয়। তবে এ বছর খামারগুলোতে কতগুলো ধবল গরু রয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানা নেই আমার। তবে খামারিদের সংখ্যা দিন দিন অনেক কমছে। ধবল গরু পালনে খামারিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
আরএআর