মানিকগঞ্জের দুই থানায় মামলা নিষ্পত্তি শূন্য হওয়া এই প্রথম

‘পুলিশ আমার মায়ের হত্যাকারীকে দ্রুত গ্রেফতার করেছে, আদলতে পাঠাইছে। মামলা করার দুই দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) নিষ্পত্তি কইরা আদালতে জমা দিছে। ঘটনার দিন থেকে পুলিশ আমাগো অনেক সহযোগিতা, উপকার করছে। পুলিশ স্যারদের কাজে আমরা অনেক সন্তুষ্ট, কৃতজ্ঞ। স্যারদের (পুলিশ) ধন্যবাদ জানাই। সেই সঙ্গে আমার মায়ের হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
এভাবেই প্রতিবেদকের কাছে কথাগুলো বলছিলেন মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের সরফদিনগর গ্রামের সম্প্রতি নিহত হওয়া নাজমা বেগমের ছোট ছেলে ও মামলার বাদী মো. জনি মিয়া। গত ৪ জুলাই নাজমাকে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে রফিক নামের এক ব্যক্তি।
পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাদের একসঙ্গে একাধিক মামলা তদন্ত করতে হয়। এ কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত শেষ করতে কয়েক মাস বা বছরও লেগে যায়। এ কারণে বিচারপ্রার্থীরাও ন্যায় বিচারবঞ্চিত হন। কিন্তু অপমৃত্যু বা অন্য কোনো ধারার নিয়মিত মামলার তদন্ত নিষ্পত্তিতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ। জেলার দুটি থানা হরিরামপুর ও দৌলতপুরে দক্ষতার সঙ্গে তদন্ত নিষ্পত্তি করায় সেগুলোতে এখন তদন্তাধীন মামলা শূন্য। মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা এটিই প্রথম।
তাই সন্তোষ প্রকাশ করে বিচারপ্রার্থী মামলার বাদী মো. জনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাবিনি এত অল্প সময়ের মধ্যে স্যাররা (পুলিশ) মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেবেন। ঘটনার দিন (৪ জুলাই) থানায় মামলা করার পরই আসামি রফিককে গ্রেফতার করেছেন। পুলিশের কাজে আমি ও আমার পরিবারের সবাই অনেক খুশি হইছি।
নিহত নাজমা বেগমের স্বামী ইসলাম সরদার বলেন, যারে হারাইছি, তারে আর ফিরা পামু না। তয় এই হত্যার সঠিক বিচার চাই। আমার স্ত্রী রফিকের কী এমন ক্ষতি করছিল যে তারে (স্ত্রী) বাঁশ দিয়া পিটাইয়া মাইরা ফালাইল রফিক? পুলিশ আমাগো মেলা উপকার করছে। শুনছিলাম মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে অনেক সময় লাগে। তয় আমাগো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ দুই দিনেই দিয়া দিছে। আমি স্যারদের কাছে আমার স্ত্রী হত্যার ন্যায় বিচার চাই।
নাজমা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হরিরামপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আরিফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি মাসের ৪ জুলাই থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। সেই মামলার তদন্তের দায়িত্বভার আমার হাতে আসে। মামলার করার দিনেই আসামি রফিককে গ্রেফতার করা হয়। পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় আসামি।
তিনি বলেন, এই মামলার তদন্ত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, হরিরামপুর থানার ওসি মহোদয় আমাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। ময়না তদন্ত প্রতিবেদন ও ডাক্তারি সদন পেতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও সহযোগিতা করেছে। তাই মামলা হওয়ার মাত্র দুই দিনে তদন্ত নিষ্পত্তি করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পেরেছি।
হরিরামপুরথানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ মিজানুর ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি থানায় যোগদান করার পরে তদন্তাধীন সব মামলার তদন্ত নিষ্পত্তি করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। আগে মাসের পর মাস সময় লাগত তদন্ত নিষ্পত্তি করতে। তবে মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় এসব মামলার তদন্ত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। বর্তমানে আমার থানায় তদন্তাধীন কোনো মামলা নেই।
জেলা দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া এলাকার আরেক বিচার প্রার্থী তোফাজ্জল হোসেন। গত মার্চ মাসে তার একটি গরু চুরি হয় বাড়ি থেকে। পরে থানায় গিয়ে মামলা করেন। দৌলতপুর থানা পুলিশ মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করেন। এ জেলায় তোফাজ্জলের মতো আরও অনেক বিচারপ্রার্থী দ্রুত সেবা পেয়ে সন্তুষ্ট।

তোফাজ্জল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার গরু হারিয়ে গেলে আমি দৌড়ে চলে যাই থানায়। আমার বিশ্বাস ছিল পুলিশ আমার উপকার করবে। আমি আশা করেছি ন্যায় বিচার পাব। পরে পুলিশ দ্রুত আমার বিষয়টি শুরু করে। পুলিশকে আমি অনেক ধন্যবাদ জানাই।
দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় প্রতিটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তারা এসব মামলার তদন্ত খুব দক্ষতার সঙ্গে করে থাকে। যে কারণে থানা মুলতবি সব মামলার তদন্ত নিষ্পত্তি করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশ পুলিশের ১৬০ বছরের ইতিহাসের এটিই প্রথম যে আমার থানায় কোনো তদন্তাধীন মামলা নেই।
জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার পুশিল কর্মকর্তা রয়েছেন ১২০ জন। আর পরিদর্শক আছেন ২২ জন। এই দুই পদমর্যাদা মিলে পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন ১৪২ জন। বর্তমানে জেলায় ৯০ দিনের ওপর কোনো মুলতবি মামলা নেই। মানিকগঞ্জের সাতটি থানার মধ্যে পাঁচটি থানায় তদন্তধীন মুলতবি মামলা রয়েছে মাত্র ৪৪টি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তিন পুলিশ কর্মকর্তার হাতে রয়েছে মাত্র একটি মামলা। বর্তমানে মানিকগঞ্জ সদর থানায় ৯০ দিনের নিচে তদন্তাধীন মামলা রয়েছে ৮টি, সিংগাইর থানায় ১৬টি, সাটুরিয়া থানায় ৭টি, ঘিওর থানায় ৬টি ও শিবালয় থানায় ৭টি। জেলার সব কটি থানায় অপমৃত্যুজনিত মামলা তদন্তাধীন আছে মাত্র ৬টি। আর হরিরামপুর ও দৌলতপুর থানায় একটি মামলাও তদন্তাধীন নেই।
সূত্রে আরও জানা যায়, জেলায় প্রতি মাসে গড়ে মামলা করা হয় ১৩০ থেকে ১৩৫টি। এসব মামলার মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মামলাই মাদক-সংক্রান্ত ঘটনার। কোনো ঘটনা ঘটলেই আসামিদের দ্রুত শনাক্ত করে গ্রেফতারের ওপর জোর দেওয়া হয় এবং একাধকি পুলিশ সদস্য নিয়ে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়। এই তদন্ত টিম প্রতিটি ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করায় তদন্তপ্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়।
এ ছাড়া তদন্ত নিষ্পত্তির জন্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাসপাতাল থেকে হাতে হাতেই নিয়ে আসা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে জেলায় খুন, দস্যুতা, ডাকাতি, ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের মতো ঘটনায় আসামি গ্রেফতার ও মামলার নিষ্পত্তির হার শতভাগ। এসব ধারায় একটি মামলাও তদন্তাধীন নেই বলে জানায় সংশ্লিষ্ট দফতর।
মানিকগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার রিফাত রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিটি মামলার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা, অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল), অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয়। তারা প্রতিটি ঘটনায় তদন্তপ্রক্রিয়া সমন্বিতভাবে এগিয়ে নেন। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কয়েক দিন পরপরই জেলার পুলিশ সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করা হয়। সেখানে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে বিশ্লেষণ করা হয়।
তিনি বলেন, প্রতিটি মামলার তদন্তপ্রক্রিয়ায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও ডাক্তারি সদন পাওয়া ক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও আমাদের সহায়তা করে থাকেন। থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তারা দক্ষতার সঙ্গে তদন্ত নিষ্পত্তি অব্যাহত রাখায় বর্তমানে অপমৃত্যু বা অন্য কোনো ধারার নিয়মিত কোনো তদন্তাধীন মামলা নেই হরিরামপুর ও দৌলতপুর থানায়। এ ধরনের ঘটনা মানিকগঞ্জে এটিই প্রথম। মুলতবি মামলার সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ঘটনা এই প্রথম বলে জানান তিনি।
এনএ