হাট ছেড়ে ক্রেতারা ঝুঁকছেন অনলাইনে

আগামী ২১ জুলাই পবিত্র ঈদুল আজহা। আর মাত্র ছয় দিন। কিন্তু শেষ সময়ে এসেও জমে ওঠেনি রাজশাহীর পশুর বাজার সিটিহাট। ভয়াবহ করোনা সংক্রমণের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক এই হাট।
আগামী রোববার (১৮ জুলাই) থেকে বসছে সিটিহাট। বুধবারও (১৪ জুলাই) বসেছিল হাট। সপ্তায় এই দুই দিনই পশু কেনাবেচা হয় সিটি হাটে। দুই হাটে পশু কেনাবেচা হয়েছে চার হাজারের মতো।
এদিকে বুধবার এক দিনেই অনলাইন পশুর হাটে বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ১৫০টি কোরবানি পশু। দিনে দিনে পশুর হাটগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে ভার্চুয়াল এসব পশুর হাট।
আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ দফতর জানাচ্ছে, সরকারি উদ্যোগে বসছে ১৪২টি অনলাইন পশুর হাট। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বসছে আরও ১ হাজার ১০৯টি হাট। প্ল্যাটফর্মে হাট বসছে আরও ৫টি। এ পর্যন্ত ভার্চুয়াল হাটে বিক্রির জন্য উঠেছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৬৭৬টি গবাদিপশু। এর মধ্যে বুধবারই আপলোড হয়েছে ৫৭ হাজার ৯৮৯টি।
এসব হাটে বুধবার (১৪ জুলাই) বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ১৫০টি কোরবানি পশু। লেনদেন হয়েছে ৩১ কোটি ৫৫ লাখ ৫৬ হাজার ৭৬১ টাকা। এ পর্যন্ত ২৯ হাজার ৩০০টি গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে ১৬২ কোটি ২১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯৯ টাকায়।
অন্যদিকে, রাজশাহীর সিটিহাটে গত রোববার (১৮ জুলাই) বিক্রি হয়েছে ২ হাজারের মতো পশু। বুধবারও (১৪ জুলাই) বিক্রি হয়েছে হাজার দুয়েক। হাটে পশুর আমদানি থাকলেও ক্রেতা না থাকায় পশু নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন বিক্রেতারা।
আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ দফতর আরও জানাচ্ছে, ভার্চুয়াল হাটে এ পর্যন্ত গরু-মহিষ আপলোড হয়েছে ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৭৩। এর মধ্যে বিক্রি হয়েছে ১৬ হাজার ৯৭৮। গত বুধবার বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৪২৮। একই দিনে বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৭২২ ছাগল-ভেড়া। যদিও বিক্রির জন্য ছাগল-ভেড়া আপলোড হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৪০৩।
বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দফতরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমজমাট নাটোরের অনলাইন পশুর হাটগুলো। কেনাবেচাও বিভাগের অন্য জেলাগুলোকে ছাড়িয়ে নাটোর।
এখানকার ৬৫১টি ভার্চুয়াল পশুর হাটে এ পর্যন্ত আপলোড হয়েছে ৩৪ হাজার ৩৬০ গরু-মহিষ এবং ৪১ হাজার ২৯২ ছাগল-ভেড়া। এর মধ্যে ৬ হাজার ২১২ গরু-মহিষ এবং ৭ হাজার ৯১৯ ছাগল-ভেড়া বিক্রি হয়েছে।

কেবল বুধবারই ১৪ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৪৭৫টি গরু এবং ১ হাজার ৮৪০টি ছাগল-ভেড়া। এ পর্যন্ত নাটোরের অনলাইন হাটে পশু বিক্রি হয়েছে ৬০ কোটি ৮২ লাখ ২৩ হাজার ২২ টাকার।
গত এক দিনে বিভাগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ কোটি ৭৩ লাখ ৭২ হাজার টাকার ১ হাজার ২২৮ গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে জয়পুরহাটে। এ পর্যন্ত জয়পুরহাটে ৩৭ হাজার ৩৫২টি পশু আপলোড হয়েছে। এর মধ্যে বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার ২৬৯টি। লেনদেন হয়েছে ৫৬ কোটি ৬৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
বুধবার পাবনায় ২ কোটি ৮৬ লাখ ৮৬ হাজার ৫০০ টাকায় ৪১৬টি পশু বিক্রি হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলায় আপলোড হয়েছে ৭৫ হাজার ৬৪৭টি পশু। এর মধ্যে বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ১৫২টি। লেনদেন হয়েছে ১৫ কোটি ৭৩ লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকা।
এ পর্যন্ত রাজশাহীতে ৬৫ হাজার ৯১৬টি পশু আপলোড হয়েছে। এর মধ্যে বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৪৮৪টি। লেনদেন হয়েছে ৯ কোটি ৬৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা। গত এক দিনে জেলায় ২ কোটি ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ৪৯৯টি পশু বেচাকেনা হয়েছে।
গত এক দিনে সিরাজগঞ্জে ১ কোটি ৯৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকায় ২৫৭টি পশু বিক্রি হয়েছে। এ পর্যন্ত সিরাজগঞ্জে আপলোড হয়েছে ১৮ হাজার ২২৩টি পশু। এর মধ্যে বিক্রি হয়েছে ২৫৭টি। এতে লেনদেন হয়েছে ৭ কোটি ৯০ লাখ ৮৬ হাজার ৮২৭ টাকা।
বুধবার ৯৬ লাখ ৯ হাজার টাকায় ১৯৬টি পশু বিক্রি হয়েছে নওগাঁয়। এই জেলায় আপলোড হওয়া মোট ৩৭ হাজার ৯৫৯ পশুর মধ্যে এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ৯৪৫টি। এতে লেনদেন হয়েছে ৪ কোটি ৬৭ লাখ ৪০ হাজার ৪০০ টাকা।
মোট ৬৭ হাজার ৮৩৪ টি পশু আপলোড হয়েছে বগুড়ায়। এর মধ্যে ৫ কোটি ৪৭ লাখ ১৭ হাজার ৭৫০ এক হাজার ১৬৪টি পশু। এর মধ্যে গত এক দিনে ৮৬ লাখ ৬১ হাজার ২৫০ টাকায় পশু বিক্রি হয়েছে ২৩১টি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত এক দিনে ৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকায় ৯টি গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে। এই জেলায় মোট ১৪ হাজার ৯৩টি পশু আপলোড হয়েছে। এর মধ্যে ১ কোটি ১৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে ১৭৮টি।
সরকারি উদ্যোগ ছাড়াও উদ্যোক্তা পর্যায়ে খোলা হয়েছে অনলাইন পশুর হাট। ভার্চুয়াল এসব হাটে পশু কেনাবেচায় উদ্বুদ্ধ করছে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ দফতর ও মাঠ প্রশাসন। কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবীরাও। এ নিয়ে প্রচার প্রচারণা চলছে বেশ।
ভার্চুয়াল হাটে যুক্ত হয়েছেন রাজশাহীর খামারি ও কৃষি উদ্যোক্তা আরাফাত রুবেল। সওদাগর এগ্রো নামের নিজস্ব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গরু বিক্রি করছেন তিনি। আরাফাত রুবেল জানান, এরই মধ্যে কোরবানিযোগ্য ৬টি গরু বিক্রি করেছেন। আরও চারটি বিক্রি চূড়ান্ত। অনলাইনে ছবি দেখে দরদাম করেছেন ক্রেতারা। পরে খামার থেকে সেগুলো চলে গেছে ক্রেতাদের ঠিকানায়। দামও পাওয়া গেছে সাধারণত হাটের মতোই।
তিনি যোগ করেন, হাটে গিয়ে দেখে-শুনে কোরবানির পশু কেনা অনেকটাই রীতি। তবে এবার করোনার কারণে লোকজন হাটে যেতে ভয় পাওয়ায় অনলাইনে পশু কেনায় ঝুঁকছেন। তবে অনলাইনে তুলনামূলক ছোট সাইজের গরু বিক্রি হচ্ছে। কেনাবেচায় ভার্চুয়াল এই হাট প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ে উঠছে পশুর হাটগুলোর।
রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পশুর হাট সিটিহাটের ইজারাদার আতিকুর রহমান কালু বলেন, হাটে কোরবানি পশু উঠছে প্রচুর। কিন্তু ক্রেতা নেই। করোনার কারণে বাইরে থেকে ব্যাপারীরাও আসছেন না। স্থানীয় পর্যায়ের কিছু ক্রেতা দেখেশুনে গরু কিনছেন। গত রোববার ও বুধবার দুই হাট মিলিয়ে চার হাজারের মতো গরু-মহিষ কেনাবেচা হয়েছে।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘদিনের লকডাউনে খামারিরা তাদের এই বিপুলসংখ্যক পশু নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। বিষয়টি মাথায় রেখে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত জুনের প্রথম থেকেই অনলাইনে পশু কেনাবেচার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। এতে বর্তমানে রাজশাহীর পশু ব্যবসায়ীদের খামারের পশু ভালো বেচাকেনা হচ্ছে। দুশ্চিন্তাও দূর হয়েছে।
আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ দফতরের উপপরিচালক ডা. উত্তম কুমার দাস জানান, সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই জমে উঠছে অনলাইন পশুর হাটগুলো। বিক্রেতারা দাম উল্লেখসহ পশুর ছবি আপলোড করছেন অনলাইনে । তা দেখে সরাসরি বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযাগ করছেন ক্রেতারা। হাটের মতো দরদাম হয়। কিন্তু হাটে যাওয়ার মতো ঝক্কিঝামেলা নেই। নির্ঝঞ্ঝাট কেনাকাটার পর পশু পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতার কাছে।
আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ দফতরের হিসাবে, রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় মোট কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে ১৪ লাখ ৮৮ হাজার ১৬০। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯০০ ষাঁড়, ১ লাখ ১৮ হাজার ১৯০ বলদ, ৮৬ হাজার ৩৫২ গাভি, ২৫ হাজার ২৬১ মহিষ, ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩২ ছাগল এবং ১৪ লাখ ৪০ ভেড়া। কোরবানিযোগ্য অন্যান্য পশু রয়েছে আরও ৪৭৮টির মতো।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এনএ