আষাঢ়ের অতিবৃষ্টিতে কৃষকের মুখে হাসি

অঝোর ধারায় বৃষ্টির ঝরার মাস আষাঢ়। বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) ছিল বাংলা এই মাসটির শেষ দিন। গাছের পাতায়, টিনের চালে কিংবা ছাদের রেলিং ছুঁয়ে খোলা আকাশের প্রান্তর জুড়ে বৃষ্টি নেমেছিল কাল। দাবদাহে তপ্ত দেহ-মন নিয়ে ঠিক এই দিনটির জন্যই যেন প্রতীক্ষা ছিল বাঙালির হৃদয়। আষাঢ়-শ্রাবণের ঋতু বর্ষায় নরম-কোমল হয়ে উঠে বাংলার মাটি। নতুন প্রাণের আনন্দে অঙ্কুরিত হয় গাছপালা, ফসলের মাঠ। নতুন ফসলের আমেজে হাসি ফুটে উঠে কৃষকের মুখে।
কৃষকের এই হাসি চলতি বছর যেন আরও চওড়া। একদিকে ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, অন্যদিকে আষাঢ়জুড়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি। এতে খুশি দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকরা। অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর অধিক বর্ষায় অফুরন্ত পানি পাওয়ায় ধান বুনতে বুনতে কৃষক দেখছেন নতুন দিনের স্বপ্ন। বর্ষার অকৃত্রিম এই দান এবার সেচের খরচ বাঁচিয়ে দেবে বলে জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকরা। গত বছরের তুলনায় এবার শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ৩০-৬০ টাকা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আষাঢ়ের বৃষ্টি একটু আগেই শুরু হয়েছিল। জ্যৈষ্ঠের শেষ সপ্তাহ থেকে পুরোদমে বৃষ্টি শুরু হয়। পুরো আষাঢ় জুড়ে হাতেগোনা কয়েকটা দিন পাওয়া যাবে, যেসব দিনে বৃষ্টি হয়নি। তাই অগ্রিম বৃষ্টি পেয়ে আমন চাষে মাঠে নেমে পড়েছেন কৃষকরা। অনেকটা ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
কৃষকরা জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে আমন চাষে বাড়তি আগ্রহ আছে। এবার বোরো ধানেও ফলন, দাম ভালো পেয়েছিলেন।
জেলায় চলতি মৌসুমে আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমন চাষের প্রস্তুতি শুরু করেছেন এই অঞ্চলের কৃষকরা। আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই বীজতলা থেকে চারা তুলে আমন রোপণ শুরু হয়। জেলার বিভিন্ন মাঠে ঘুরে দেখা গেছে, এখন পুরোদমে আমন রোপণ চলছে।
সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নের চাঁপাই-গোরস্থান পাড়ার কৃষক ফারুক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার বোরো ধান চাষ করে বাম্পার ফলন পেয়েছি। সেই সঙ্গে দামও খুব ভালো ছিল। দুই বিঘা আমন চাষের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য বছর বৃষ্টি হলেও গভীর নলকূপ থেকে কিছু পানি নিতে হয়। তবে এ বছর তা করতে হয়নি।
তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে আমন চাষে তেমন সেচ খরচ লাগে না। এছাড়া সার খরচও কম। বর্ষার পানির ওপর নির্ভর করে উঁচু-নিচু সকল জমিতে আমন চাষাবাদ করা হয়ে থাকে। এ বছর অগ্রিম বৃষ্টি হওয়ায় দেরি না করে আমন চাষে নেমে পড়েছেন চাষিরা।
আরেক কৃষক সুমন আলী বলেন, সদর উপজেলার খিন্নিতলা মাঠে দেড় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। এক ফোঁটা পানিও কিনতে হয়নি। এতে খরচ কমেছে। তবে এ বছর ধান রোপণ করা শ্রমিকদের মজুরি গত বছরের চেয়ে ৩০-৬০ টাকা বেড়েছে। গতবছর যেখানে দৈনিক একজন শ্রমিকের মজুরি ছিল ৩০০-৩২০ টাকা, সেখানে চলতি বছরে তা বেড়ে ৩৫০-৩৮০ টাকা হয়েছে। ধানের দাম বাড়ার কারণে মজুরি বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
শিবগঞ্জ উপজেলার নেজামপুরে কৃষক সবুর আলী ১২ বিঘা জমি চাষাবাদ করেছেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমি যে মাঠে জমি চাষাবাদ করেছি, সেই মাঠে বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) পর্যন্ত প্রায় বারো আনা (৭৫ শতাংশ) ধান লাগানো হয়ে গেছে। আশা করছি, ঈদের আগে (২১ জুলাই ঈদুল আজহা) এই মাঠের প্রায় সব ধান লাগানো হয়ে যাবে।
ফতেপুর ইউনিয়নের সানপুর গ্রামের আব্দুর রাকিব ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। রমজানে বাড়ি এসে আর কাজে ঢাকা যাননি। বোরো ধান কাটা ও আমন ধান লাগানোর জন্য থেকে গেছেন আব্দুর রাকিব। তিনি বলেন, রাজমিস্ত্রির কাজ করলেও ধান কাটা ও ধান লাগানোর সময় বাড়ি চলে আসি।
তিনি আরও বলেন, চলতি বছর খুব কাজের চাপ। ধান লাগানোর জন্য আগামী ৫ দিনের বুকিং হয়ে গেছে। সকালে কাজে গিয়ে দুপুর ২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করেই সাড়ে তিনশ টাকা আয় হয় বলে এই কাজেই আগ্রহ। আব্দুর রাকিব আরও জানান, তার মতো অনেকেই বিভিন্ন পেশা থেকে এসে ২০-২৫ দিনের জন্য ধান লাগানোর শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, চলতি মৌসুমে আমন চাষাবাদ করার জন্য জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে বীজতলার কাজ শুরু করেছেন জেলার কৃষকরা। আষাঢ়ের শুরুতেই পুরোদমে বৃষ্টিতে আমন রোপণ শুরু করেছেন তারা। আষাঢ়ের অতিরিক্ত বৃষ্টিতে কৃষকদের খরচ অনেক কমে যাবে বলেও জানান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫৩ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা গতবছর ছিল ৫৩ হাজার ২২০ হেক্টর। বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) পর্যন্ত জেলায় প্রায় ২০ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে ধান রোপণ শেষ হয়েছে। এ বছর আমন মৌসুমে ২ লাখ ১১ হাজার ৮৬৬ মেট্রিক টন ধান ও ১ লাখ ৪১ হাজার ২৪৪ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।
মো. জাহাঙ্গীর আলম/এমএইচএস