বেহালা বিক্রিই দুলাল মিয়ার ৪৫ বছরের পেশা

কাঁধে দুই প্লাস্টিকের বড় ব্যাগ। পরনে পুরোনো লুঙ্গি আর গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি। হাতে নিজের বানানো বাঁশের বেহালা। পাড়ায় পাড়ায় হাঁটছেন আর বেহালা বাজাচ্ছেন। পেছনে উৎসুক শিশুদের দল। যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।
এভাবেই দুলাল মিয়া নিজের তৈরি বাঁশের বেহালা নিয়ে ঘোরেন সুনামগঞ্জের অলিগলি ও গ্রাম-শহরে। বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়েই কোনোরকমে চলে সংসার। ৪৫ বছর ধরে এভাবেই চলছেন তিনি।
দুলাল মিয়ার বাড়ি বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের পাহাড়ের পাদদেশে বেতাগড়া গ্রাম। পরিবারে আছে ৬ জন সদস্য। ২ ছেলে, ২ মেয়ে। বড় সন্তানের নাম হামিদা খাতুন। বিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয় সন্তানের নাম জহুর ইসলাম। সে শহরের একটি দোকানে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে। তৃতীয় সন্তান তহুরা বেগম। তাকেও বিয়ে দিয়েছেন। চতুর্থ সন্তান দীন ইসলাম। মাদ্রাসায় হাফিজিয়া বিভাগে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাননি কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গরিব মানুষ আমরা। কোনোরকম চলি। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাব কী করে? বাঁশ কিনি। কাটি। সেগুলোকে সবাই মিলে খেলনা বানানোর জন্য উপযুক্ত করি। সকালে বের হই। রাতে ফিরি। মাঝেমধ্যে ফিরতে পারি না। মানুষের বাড়িতে বলেকয়ে থাকি। আমি মানুষ তো, তাই মানুষের ওপর মানুষের দয়া হয়। থাকতে দেয়। আবার সকালে চলে আসি।
অন্যের ওপর নির্ভর করব না। নিজে আয় করে সৎভাবে বাঁচব। তাই ৪০-৪৫ বছর ধরে এই পেশায় আছি। এভাবে ঘুরতে ভালো লাগে। বাঁশ কিনে নিজের হাতে তৈরি করি বেহালা, চরকি ও অন্যান্য খেলনা। সেগুলো বিভিন্ন উপজেলার গ্রামগঞ্জে ঘুরে বিক্রি করি। বাঁশের তৈরি বেহালা ২০ টাকা ও চরকি ১০ টাকা দাম
দুলাল মিয়া বলেন, অন্যের ওপর নির্ভর করব না। নিজে আয় করে সৎভাবে বাঁচব। তাই ৪০-৪৫ বছর ধরে এই পেশায় আছি। এভাবে ঘুরতে ভালো লাগে। বাঁশ কিনে নিজের হাতে তৈরি করি বেহালা, চরকি ও অন্যান্য খেলনা। সেগুলো বিভিন্ন উপজেলার গ্রামগঞ্জে ঘুরে বিক্রি করি। বাঁশের তৈরি বেহালা ২০ টাকা ও চরকি ১০ টাকা দাম। বাচ্চারা সেগুলো আগ্রহের সঙ্গে কিনে নেয়। দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। আবার কোনো কোনো দিন বিক্রিই হয় না।
জানালেন, তার বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন পাঁচ বছর আগে। তিনি সুখেই স্বামীর সংসার করছেন। তৃতীয় সন্তান তহুরা বেগমের বিয়ে হয়েছে এক বছর আগে। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তার। দুলাল মিয়া জানান, শিশু বয়সে বিয়ে হলেও দক্ষ হাতে সংসার সামলাচ্ছেন তহুরা।
দিন আনি দিন খাই। যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া যায়, ভালো। কিছু হলে গরিবের মেয়ের কোনো দোষ না থাকলেও সব দুর্নাম এসে পড়ে মেয়ের ঘাড়ে। পরে মানসম্মান যাবে। তাই কম বয়সে বিয়ে দিয়েছি বলে জানান তিনি।
এই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার বয়স এখন প্রায় ৫৫ বছর। তবে ধীরে ধীরে শরীর রোগে কাবু করছে। এ নিয়েই প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে শিশুদের আনন্দ দেন। খেলনা বিক্রি করে উপার্জন করেন।
দ্বিতীয় সন্তান জহুর ইসলাম শহরে কাপড়ের দোকানে কাজ করছে। সন্তান টাকা আয় করার পরও কেন এখনো এ রকম পরিশ্রম করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে দুলাল মিয়া বলেন, সে প্রথমে কিছু পাঠাত। এখন পারে না। খুব অল্প বেতন পায়। সে টাকা তার নিজেরই প্রয়োজন। বাসা ভাড়া, খাওয়ার খরচ আছে শহরে। তাই আমি এখন চাপ দিই না।
দুলাল বলেন, বাড়িতে আছে ছোট ছেলে। ১২ বছর বয়স। সে ‘ছিনাকান্দি হাফিজিয়া মাদ্রাসায়’ পড়াশোনা করে। ছোট ছেলেটিকেই হাতের কাজে লাগাই। হাফিজিয়া পড়ার পাশাপাশি খেলনাপাতি বানাতে সহযোগিতা করে। তবে এসবের আগের মতো চাহিদা নেই মানুষের। এত দিন করেছি এখন এই পেশা ছাড়তেও পারি না। খুব মায়া হয়। যত দিন নিশ্বাস আছে, এ পেশাতেই থাকব। খেলনা পেয়ে শিশুদের মুখে যে হাসি দেখি, তাতেই তো সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।
এনএ