একসঙ্গে বাবা-মা ও দাদা-দাদিকে হারিয়ে অসহায় তারা

আপন বলতে আর কেউ রইল না চার ভাই-বোনের। বজ্রপাতে মারা গেছেন তাদের বাবা-মা, দাদা-দাদিসহ পরিবারের ৯ জন সদস্য। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় সিহাব (১৪)। তার ছোট তিন বোন সোনিয়া (১০), তানিয়া (৮) ও তাজরিন (২)। এদের মধ্যে সিহাব মানসিক ভারসাম্যহীন। ফলে সবার দুঃচিন্তা তাদেরকে নিয়েই। চার ভাই-বোনকে দেখার মতো আর কেউ বেঁচে নেই। বজ্রপাতে পরিবারের সকলকে হারিয়ে তারা এখন অসহায়।
গতকাল বুধবার (০৪ আগস্ট) দুপুরে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাঁকা ঘাটে বজ্রপাতে বরপক্ষের ১৬ জন এবং স্থানীয় এক মাঝি ঘটনাস্থলেই মারা যান। বরপক্ষের মোট ৪৭ জন সদস্য পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে কনের বাড়িতে যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে। এছাড়াও বজ্রপাতের ঘটনায় আরও অন্তত ১২ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
সরেজমিনে জানা গেছে, বড় তিন ছেলে-মেয়েকে বাড়িতে রেখে ছোট মেয়ে তাজরিনকে নিয়ে ভাগনে মামুনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের মহরাজনগর ডানপাড়ার সাদিকুল (৩৫), তার স্ত্রী টকিয়ারা বেগম (৩০), বাবা তবজুল (৭০) ও মা জমিলা বেগম (৫৮)। বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। তবে বেঁচে গেছেন দুই বছরের শিশু তাজরিন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাজরিনকে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে সে হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (০৫ আগস্ট) দুপুরে নিহত সাদিকুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আশপাশের গ্রাম থেকে দলে দলে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ছুটে আসছেন। ছোট বোন তাজরিন হাসপাতালে ভর্তি থাকায় বাকি তিন ভাই-বোনকে ঘিরে রেখেছে সবাই। তবে তাদের মুখে কোনো কথা নেই। বড় ভাই সিহাব মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় কথা বলতে পারে না তেমন। বাকি দুই বোনও জানে না তাদের বাড়িতে কী হয়েছে, কোথায় গেছে তাদের বাবা-মা ও দাদা-দাদি।

শিশুদের নানি মুনিজা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা। তাদের দেখাশোনা করারও কেউ থাকল না। তারা এখন কী খাবে, কেমন করে খাবে সেটা আল্লাহ ছাড়া কেউও জানে না। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাবা-মা না থাকলে দাদা-দাদি অনেককেই মানুষ করে। কিন্তু তাদের কী দুভার্গ্য যে তাদের দাদা-দাদিও মারা গেল।
তাদের খালা নুরেসা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বড় ছেলেটার মাথায় সমস্যা। তারপর আরও তিন মেয়ে রয়েছে। তাদের আদর-যত্ন, ভালোবাসা দেওয়ার কেউ নেই। সরকার ও প্রশাসনকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাই।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও শিশু ফুফা মোহাম্মদ আলী জানান, বজ্রপাতের সময় সেখানেই তাদের বাবা-মা মারা যান। কিন্তু আল্লাহর রহমতে মায়ের কোলে থাকা শিশু তাজরিন বেঁচে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, কনের বাড়িতে যাওয়ার পথে বৃষ্টি আসলে দক্ষিণ পাঁকা ঘাটের একটি ছাউনিতে তারা আশ্রয় নেন। তার কিছুক্ষণ পরই বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই ১৭ জন মারা যায়।
বজ্রপাতে মারা যাওয়া অন্যরা হলেন- সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ঘাটাপাড়ার সাত্তার আলীর ছেলে সহবুল (৩০), চর সূর্যনারায়ণপুর গ্রামের টিপুর স্ত্রী বেলী বেগম (৩২), মহরাজনগর ডানপাড়ার জামালের ছেলে লেচন (৫০), রফিকুল ইসলামের ছেলে বাবলু (২৬), তেররশিয়া দক্ষিণপাড়ার মৃত মহবুলের ছেলে রফিকুল (৬০), সূর্যনারায়ণপুরের ধুনু মিয়ার ছেলে সজিব (২২), একই গ্রামের সাহালালের স্ত্রী মৌসুমী (২৫), বাবুডাইংয়ের মকবুলের ছেলে টিপু (৪৫), কালুর ছেলে আলম (৪০), মোস্তফার ছেলে পাতু (৪০), সুন্দরপুরের সেরাজুলের ছেলে আতিকুল ইসলাম ডাকু (২৪), জনতার হাট গ্রামের বাবুর ছেলে তামিম (৫) ও নৌকার মাঝি শিবগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ পাঁকা গ্রামের রফিকুল ইসলাম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইফফাত জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মৃতদের প্রত্যেক পরিবারকে মরদেহ দাফনের খরচ হিসেবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে ২৫ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আহতদের ৭ হাজার করে টাকা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। পরবর্তীতে আরও সহায়তা করা হবে বলেও জানান তিনি।
জাহাঙ্গীর আলম/আরএআর