করোনায় স্বামী ও চাকরি হারানো মায়িশার পাশে পুলিশ সুপার

করোনায় স্বামী মতিউর রহমান ও শিক্ষিকা মায়িশা ফারহা চাকরি হারান। এরপর মতিউর রহমান সংসার চালাতে শুরু করেন ভাড়ায় ইজিবাইক চালানো। ইজিবাইক চালিয়ে কোনো রকমে চলছিল সংসার। এর কিছু দিনের মধ্যে মতিউর রহমান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হোন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। এরপর মায়িশা দিশেহারা হয়ে পড়েন। বগুড়া শহরে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেন। এরপর শহরের আকবরিয়া গ্রুপে যোগাযোগ করে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ শুরু করেন মায়িশা।
ফেসবুকের মাধ্যমে বিষয়টি নজরে আসে বগুড়ার নবাগত পুলিশ সুপার (এসপি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর। পরে তিনি দ্রুত সাবেক শিক্ষিকা মায়িশা ও তার পরিবারের পাশে দাঁড়ান। মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) দুপুরে বগুড়া পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে মায়িশার হাতে নগদ অর্থ ও তার পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন কাপড় উপহার তুলে দেন। করোনাকালে শিক্ষিকা মায়িশার পরিবারের দায়িত্ব নেন।
মায়িশার পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার সময় নবাগত পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা জীবন বাজি রেখে জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ চালাচ্ছি। পাশাপাশি পুলিশ সামাজিক দায়িত্ব থেকেও এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। আপনাদের সংবাদের মাধ্যমে এই মর্মান্তিক বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। একজন শিক্ষকের মেয়ে ও শিক্ষকের এই পরিণতি আমরা হতে দিতে পারি না। তাই প্রাথমিকাভাবে মায়িশার পরিবারকে আমরা নগদ অর্থ উপহার দিয়েছি। পাশাপাশি তাদের সব রকম দায়িত্ব জেলা পুলিশ গ্রহণ করেছে। যেহেতু মায়িশা শিক্ষিত, তাই তার যোগ্যতা অনুযায়ী কোন চাকরি দেওয়া যায় সেটা আমরা চেষ্টা করছি। তাকে যেন তার আর পিছে ফিরে তাকাতে না হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বগুড়া শহরের নাটাইপাড়া এলাকার একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করতেন মায়িশা ফারহা (২৪)। ঢাকায় একটি অরফানেজে বড় হয়েছেন মায়িশা। তাকে দত্তক নেন বগুড়ার এক দম্পতি। পরে তারা তাকে নিজের মেয়ের মতো করে করে বড় করেন। মায়িশা স্নাতকে পড়ার সময় বান্ধবীর মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে ওঠে নঁওগা জেলার মতিউর রহমানের সঙ্গে। এরপর মতিউরের পরিবারের অমতে তাদের বিয়ে হয়।
মতিউর পেশায় একজন বীমা কর্মকর্তা ছিলেন। সংসারজীবনে তাদের দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। যাদের বর্তমান বয়স পাঁচ বছর ও আড়াই বছর। হঠাৎ করোনার থাবায় চাকরি হারান মতিউর ও মায়িশা। এরপর মতিউর চক্ষুলজ্জা ছেড়ে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন নওগাঁতে। তবে এই বছর জানুয়ারি মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। এদিকে দত্তক নেওয়া বৃদ্ধ বাবা-মা ও দুই সন্তানকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন মায়িশা। সন্তানদের দুধের টাকা জোগাতে একপর্যায়ে শুরু করেন ভিক্ষাবৃত্তিও।
এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও বগুড়ার সিনিয়র এক সাংবাদিকের নজরে আসলে তিনি মায়িশার সঙ্গে যোগাযোগ করে জেলার একটি বড় গ্রুপ অব কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে দেন। মায়িশা গত এক সপ্তাহ হলো সেখানে পরিছন্নতা কর্মীর সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত আছেন।
পুলিশ সুপার কার্যালয়ে মায়িশার দত্তক নেওয়া বাবা রুস্তম আলী বলেন, আমাদের এই অসময়ে এসপি স্যার পাশে দাঁড়িয়েছেন। মনে হচ্ছে আমি ও আমার স্ত্রী মারা গেলেও আমার মেয়ে ও নাতনির জন্য এখন একজন অভিভাবক হিসেবে বড় ভাই আছেন। আল্লাহ এসপি স্যারকে দীর্ঘজীবী করুন। উনি নিজে আমাদের গাড়ি পাঠিয়ে ডেকে এনে সব দায়িত্ব নিয়েছেন ও সহযোগিতা করেছেন। আমার এই কষ্ট ও আজকের প্রাপ্তি ভাষায় বুঝাতে পারবো না।
মায়িশা ফারহা জানান, আমি ভাবতে পারিনি। কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবেন। এসপি স্যার ফেরেশতার মতো আমাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পাশাপাশি সাংবাদিক ভাই ও আমি যে কোম্পানিতে কাজ করি সেই কোম্পানির মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আমি কোনো সহযোগিতা চাই না। আমি কাজ চাই। যেন আমার দুই বাচ্চা ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারি। তার বিষয়টি প্রকাশের পর ফ্রেশ গ্রুপ থেকে তাকে বিকাশে ১০ হাজার টাকা ওপহার পাঠানো হয়েছে।
এছাড়াও পুলিশ সুপার কার্যালয়ে জেলা পুলিশের পাশাপাশি মায়িশার পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী উপহার দেন রাজাবাজার আড়ৎ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ।
মায়িশা ও তার পরিবারকে উপহার প্রদানের সময় জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরী (প্রশাসন), আব্দুর রশিদ (অপরাধ), মোতাহার হোসেন (ডিএসবি), হেলেনা আক্তার (সদর হেডকোয়ার্টার) ও সদর থানার ওসি (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন।
সাখাওয়াত হোসেন জনি/আরএআর