মুক্ত মানিকগঞ্জে পতাকা ওড়ে ১৪ ডিসেম্বর

আজ ১৩ ডিসেম্বর, রোববার। মানিকগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার মুক্ত হয় মানিকগঞ্জ।
মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক আক্রমণে ভীত হয়ে মানিকগঞ্জ থেকে পালিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। পরের দিন ১৪ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে লাল সবুজের পতাকার ওড়ান তৎকালীন এম এল এ খন্দকার মাজহারুল হক চাঁন মিয়া।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর ক্রাক ডাউনের খবর পাওয়ার পর মহকুমা (জেলা) মানিকগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য তৎকালীন এমএলএ মাজহারুল হক চাঁন মিয়াকে চেয়ারম্যান করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ক্যাপ্টেন (অবঃ) আব্দুল হালিম চৌধুরী, মো. মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া, খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী, মীর আবুল খায়ের ঘটু, মফিজুল ইসলাম খান কামাল।
২৫ মার্চ রাতে মানিকগঞ্জের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়। স্বাধানীতাকামী মুক্তিবাহিনী মানিকগঞ্জের ট্রেজারি থেকে গোলাবারুদ ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। পরে মানিকগঞ্জের আরিচা ফেরিঘাট বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২৬ মার্চ ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর বাড়ির আলুর গুদামের পেছনে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ওইদিন জেলা কমান্ড কাউন্সিল সদস্যরা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য শপথ গ্রহণ করেন।
আলবদর, আল শামস এবং রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কমিটি গঠন, অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও ফেরিঘাট বন্ধের তথ্য পাকিস্তানি সেনাদের কাছে ফাঁস করে দেয়। আরিচা ফেরিঘাট বন্ধ থাকায় এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হেলিকপ্টারযোগে মানিকগঞ্জ শহরে বিপুল পরিমাণে পাকিস্তানি সেনা ঢুকে পড়ে।
পাকিস্তানিদের প্রতিহত করার চিন্তা করলেও কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা জেলার হরিরামপুর উপজেলার চরাঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়। অনেকে আবার ভারতে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে আসে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
পাকসেনা, আল-বদর, আল-শামস, রাজারকারদের আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে মানিকগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা দুটি ভাগে কাজ করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সকল কার্যক্রম অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে চলে।
১৭ জুলাই ঘিওর থানায় আক্রমণ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে মুক্তিযোদ্ধারা। ১৮ আগস্ট পাকবাহিনী হরিরামপুর থানায় ঢোকার চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ১৩ আগস্ট সিও অফিসে সংরক্ষিত পাকবাহিনী ক্যাম্প দখলের জন্য মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে।
এতে পাকসেনারা পরাজিত হয়। সিও অফিস থেকে পাকবাহিনীর ৭০টি রাইফেল, তিনটি এলএমজি এবং সাত বক্স গুলি ছিনিয়ে নেয়। পাকসেনাদের ক্যাম্প দখলের পরে সেখানকার ওয়ারলেস অফিস আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ সময় আগুনে পুড়ে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান।
২২ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামে হামলা চালায়। ওই হামলায় তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান এবং জমিদার সিদ্বেশ্বর রায় প্রসাদ চৌধুরীসহ ৪৩ জন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধে মানিকগঞ্জে ৪২টি সম্মুখযুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এই যুদ্ধে মানিকগঞ্জে ৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং আহত হন অনেকে। এ সময় পাকবাহিনীর সেনারা স্বাধীনতাকামী কয়েক হাজার মানুষকেও হত্যা করে।
এই যুদ্ধে মানিকগঞ্জে স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) বদুরুল আলম (বীর প্রতীক), ইব্রাহিম খান (বীর প্রতীক), শহীদ মাহফুজুর রহমান (বীর প্রতীক) এবং মোহাম্মদ আতাহার আলী খান (বীর প্রতীক) খেতাবপ্রাপ্ত হন।
মানিকগঞ্জের সাত উপজেলা থেকে অক্টোবরের শেষ ও নভেম্বর থেকে পাকসেনারা ক্যাম্প ছেড়ে চলে যেতে থাকে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ থেকে পাকবাহিনী চলে গেলে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। হানাদারমুক্ত হয় মানিকগঞ্জ।
এসপি