গ্রামবাসীর অর্থায়নে দুই পারের সেতুবন্ধ

‘দশে মিলে করি কাজ’ প্রবাদটা আরেকবার সত্য প্রমাণ করলেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় স্থানীয় এলাকাবাসী। নিজেদের উদ্যোগে আড়িয়াল খাঁ নদের ওপর নির্মাণ করেছেন কাঠের সেতু। ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্যের এই সেতু নির্মাণে টানা এক মাস কাজ করেছেন তারা। কাঠ, বাঁশ ও রং―সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা।
উপজেলার চর আড়ালিয়া ইউনিয়ন ও আমিরগঞ্জ ইউনিয়নের সংযোগস্থলে বটতলী গ্রামে আড়িয়াল খাঁ নদের ওপর এই সেতু নির্মাণ করা হয়।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে এই নদীর ওপর পাকা সেতু নির্মাণ করার আশ্বাস দিলেও কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় ব্যক্তিদের। সবশেষ সব আশ্বাসের অবসান ঘটিয়ে গ্রামবাসীদের উদ্যোগ ও নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হলো এই কাঠের সেতু।
আমিরগঞ্জ ইউনিয়ন ও চর আড়ালিয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত রায়পুরার পশ্চিমাঞ্চল। দুই ইউনিয়নের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে মেঘনার শাখা আড়িয়াল খাঁ। এই নদীর শাখাকে সীমানা ধরেই ৯টি ওর্য়াড নিয়ে ১৯৬৫ সালে আমীরগঞ্জ ইউনিয়ন থেকে বিভক্ত হয়ে চর আড়ালিয়া ইউনিয়ন গঠিত হয়। সেই ইউনিয়নের ৬, ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে বটতলী গ্রাম। এ গ্রামে ভোটার সংখ্যা ছয় হাজারেরও বেশি। তাদের যাতায়াতের প্রধান পথ এই নদ।
এই গ্রামে নেই কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নেই হাটবাজার। এখানকার মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে সুষ্ঠু চিকিৎসাসেবা থেকেও। নৌকার ওপর ভরসা করে নদের অপর পাড় মির্জানগর, হাসনাবাদ ও মনিপুরার স্থানীয় কয়েকটি স্কুলে যেতে হয় এখানকার শিক্ষার্থীদের। জরুরি রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাওয়াটাও একটা যুদ্ধের মতো পরিশ্রম। সময়মতো পাওয়া যায় না নৌকা। আবার কখনো কখনো নৌকা পাওয়া গেলেও বর্ষাকালে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নদের স্রোত ও রাতে ভেসে আসা কচুরিপানা।
এদিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে এই নদীর ওপর পাকা সেতু নির্মাণ করার আশ্বাস দিলেও কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় ব্যক্তিদের। সবশেষ সব আশ্বাসের অবসান ঘটিয়ে গ্রামবাসীদের উদ্যোগ ও নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হলো এই কাঠের সেতু।
১১ জানুয়ারি সন্ধ্যা নাগাদ রং দেওয়ার মাধ্যমে এই কাজের সমাপ্তি হয়। ১২ জানুয়ারি সকালে এই সেতু দুই পারের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ফলে দুর্ভোগ কিছুটা হলেও লাঘব হবে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।
ওয়াহাব মিয়া নামের এক এলাকাবাসী জানান, আমরা জন্মের পর থেকেই অনেক কষ্ট করেছি এ জায়গা দিয়ে। যাতায়াতের সুবিধা না থাকায় বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। নৌকার ওপর ভরসা করে চলতে হয়। ঝড়-তুফানের দিনে নৌকাও থাকে না।
এলাকাবাসীর এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এখানকার পাকা সেতু নির্মাণের বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য অবগত আছেন। আশা করছি অচিরেই এখানে একটি পাকা সেতু নির্মাণ করা হবে।
হাসানুজ্জামান সরকার, চেয়ারম্যান, চরআড়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ
এলাকাবাসী আফসার উদ্দিন বলেন, সন্ধ্যার পরেই এখানে নৌকা পাওয়া যায় না। এই সেতু নির্মাণ করায় আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে। দুই পারের মানুষই ইচ্ছামতো যাতায়াত করতে পারছি।
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক আরিফ হোসেন জানান, এই সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দুই পারের মানুষের মধ্যে একটা সম্প্রীতি তৈরি হয়েছে, যা গ্রামীণ জনপদের উন্নতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাহেলা বেগম নামের এক পথচারী জনান, মেয়েদের প্রসববেদনার সময় হলে এই অঞ্চলের মানুষ একটা ভয়ে থাকে। সময়মতো নৌকা পাওয়া যায় না। এখন এই সেতু নির্মাণের ফলে এই ভয়টা আর থাকবে না।
নুরুল ইসলাম নামের আরেকজন জানান, জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের সময় হলেই বিভিন্ন আশার বাণী শোনান। নির্বাচনের পর তাদের আর পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিনের এই সমস্যা দূর করার লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ নিয়ে আমরা কাঠের সেতু নির্মান করেছি। আশা করব, অচিরেই এখানে একটি পাকা সেতু নির্মান করা হবে।
সেতু নির্মাণের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, এই অঞ্চলটা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। নৌকাই একমাত্র ভরসা। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না, রোগী নিয়ে নৌকার আশায় বসে থাকতে হয় ইত্যাদি সমস্যার কথা চিন্তা করেই স্থানীয়ভাবে নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
চরআড়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান সরকার এলাকাবাসীর এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসনীয়। এখানকার পাকা সেতু নির্মাণের বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য অবগত আছেন। আশা করছি অচিরেই এখানে একটি পাকা সেতু নির্মাণ করা হবে।
এনএ