বরিশালে গুলিতে চোখ হারানো তিন আ.লীগ নেতাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবার

বরিশালে আনসার সদস্যদের গুলিতে চোখ হারানো ইউপি সদস্যসহ তিন আওয়ামী লীগ নেতাকে নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ। বর্তমানে তারা ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সন্দেহভাজন আসামি হওয়ায় তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে গ্রেফতারের ভয়ে আহতরা নির্বিঘ্নে চিকিৎসা নিতে পারছেন না বলে অভিযোগ স্বজনদের। তারা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
এদিকে আহতদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজনে দেশের বাইরে পাঠিয়ে হলেও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার দাবি পরিবারের। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন আহত তিন আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারের সদস্যরা।
বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ থেকে জানানো হয়েছে, প্রথম অবস্থায় আনসার সদস্যদের গুলিতে কমপক্ষে ৬০ জন নেতাকর্মী আহত হন। এর মধ্যে ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনির ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসানের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে মেয়রের পায়ে গুলি করা হয়েছে- এমন খবর পেয়ে শহরের উপকণ্ঠ কাশিপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা আতিকুর রহমান রায়হান ঘটনাস্থলে ছুটে এসে গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখ হারিয়েছেন। পুরো ঘটনাটি অনাকাঙিক্ষত বলে উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
আহত আতিকুর রহমান রায়হানের বাবা আমির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার পর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিটন মোল্লা শুধু খোঁজখবর নিচ্ছেন। এছাড়া কেউ একবারের জন্যও খোঁজ নেননি।
তিনি বলেন, ঘটনার দিন (১৮ আগস্ট) রায়হান ছিল চেয়ারম্যানের বাসায়। সেখানে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। রাত ১১টার দিকে সে খবর পায় বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়রকে ইউএনও গুলি করেছেন। এই খবর শুনে রায়হান ছুটে যায় সদর উপজেলা পরিষদের সামনে। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই আবারও ইউএনওর বাসার দিক থেকে গুলি করা হয়। রায়হান গুলিবিদ্ধ হয়। বিষয়টি আমরা জেনেছি রাত ১২টার পর।
আমির হোসেন বলেন, আমার সন্তানের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। আমার আর কোনো দাবি নেই। আমার ছেলেকে সুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
রায়হানের মা নূরজাহান বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দল করতে গিয়ে এভাবে একটা ছেলে পৃথিবী থেকে চলে যাবে, পঙ্গু হবে এই ধরনের রাজনীতি আমি চাই না। আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে এই খবর শোনার পর ভেবেছিলাম ও মারা গেছে। আমার দাবি একটাই, আমার ছেলে আমার কোলে ফিরে আসুক। ওর চোখ যেন ভালো হয় সেই ব্যবস্থা করা হোক।
তিনি বলেন, রায়হানের বাড়ি যে বরিশালে তা হাসপাতালেও বলেনি। তাহলে পুলিশ ওকেও গ্রেফতার করবে। এই কারণে সঠিক কোনো চিকিৎসা পাচ্ছে না আমার ছেলে।
রায়হানের বড় ভাবি শারমিন বেগম সনিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, রায়হান ঢাকায় পালিয়ে পালিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। তার পাশে গুলিবিদ্ধ আরও দুইজনকে নেওয়া হয়েছিল। তাদের পুলিশ ঘেরাও করে রাখে সব সময়। তাদের পুলিশ নিয়ে গেছে বলে জেনেছি। এজন্য রায়হান হাসপাতালে মিথ্যা তথ্য দিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। কখনো তাকে বলতে হচ্ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, কখনো বলতে হচ্ছে চোখে কাচ ঢুকেছে।
এখন পর্যন্ত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বা দল থেকে কেউ খোঁজ নেয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনীতি থেকে প্রতিহিংসার অবসান হওয়া উচিত। এভাবে কোনো মায়ের সন্তানের চোখ হারানোর কষ্ট আমরা দেখতে চাই না। তিনি গুলিবর্ষণকারীদের বিচারের দাবি জানান।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনিরুল ইসলাম মনিরের আত্মীয় জহিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, বুধবার (১৮ আগস্ট) রাতে মনির খবর পান ইউএনও অফিসের সামনে মেয়রকে গুলি করা হয়েছে। খবর পেয়ে মনির সেখানে ছুটে যান। ইউএনও অফিসও ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে। গিয়ে সেখানে দাঁড়াতেই বিপরীত দিক থেকে গুলি বর্ষিত হয়। তার মুখমন্ডলে এবং শরীর মিলিয়ে ৪২টি গুলি লেগেছে। গুলিতে একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে মনিরের।
তিনি বলেন, ঘটনার পরপরই মনিরের পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে গেছেন। তারা কেউ বরিশালে নেই। পুরো পরিবার আতঙ্কেও আছেন। তাদেরও নাকি পুলিশ নজরদারিতে রেখেছে।
প্রয়াত বীর প্রতীক রফিকুল আহসান বাদশার স্ত্রী মোহসিনা পারভীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে তানভীরের চোখে ৫টি গুলি এখনো আছে। এগুলো আর উঠানো যাবে না। ডাক্তার বলেছে তানভীর আর কোনোদিন চোখে দেখতে পারবে না। ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনজন পুলিশ আমার ছেলেকে আটকে রেখেছে।
তিনি বলেন, আমি বীর প্রতীকের স্ত্রী। তিনি মারা যাওয়ার পরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে আমার স্বামীর সনদ আমি এনেছি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিজ চোখে দেখেছি। যতদূর জেনেছি, বুধবার রাতে ইউএনও অফিসের সামনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে গুলি ছুড়তে হবে। আমার সন্তান যাদের গুলিতে চোখ হারিয়েছে তাদের বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার অনুরোধ, অকারণে গুলিবর্ষণকারীদের বিচার আপনি করুন। আপনি আমার সন্তানের সুচিকৎসার ব্যবস্থা করুন।
চোখ হারানো তানভীরের স্ত্রী জান্নাতি আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) দুপুর ২টায় আমার স্বামীকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়। কিন্তু রাত ১১টা পর্যন্ত পুলিশ আমাদের হাসপাতালে আটকে রাখে। এখন ঢাকায় চিকিৎসা নিলেও পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। আমাদের চার মাসের একটি সন্তান রয়েছে। সন্তান নিয়ে আমি অনিশ্চয়তায় আছি।
তিনি বলেন, ওই রাতে গুলিবর্ষণের মত কোনো ঘটনা ঘটেনি। সিটি মেয়র ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার পরপরই ইউএনওর বাসার ভেতর থেকে গুলি করা হয়। এতে আমার স্বামীর শরীরে ৫০টির ওপরে গুলি লেগেছে। আমরা ওর সুচিকৎসা নিয়ে চিন্তিত।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকায় যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা সাসপেক্টেড আসামি। এজন্য পুলিশি নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তবে চিকিৎসা গ্রহণে কোনো বাধা দেওয়া হচ্ছে না।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ঢাকায় হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। যেহেতু তারা মামলার আসামি এজন্য পুলিশ তাদের নজরদারিতে রেখেছে। সুচিকিৎসায় বাধা দেওয়ার খবর আমাদের কাছে নেই।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার (১৮ আগস্ট) রাতে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ কম্পাউন্ডে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের ব্যানার অপসারণ করতে যান বরিশাল সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। এতে বাধা দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এ নিয়ে বিরোধের জেরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসায় প্রবেশ করেন। তাদের প্রতিহত করতে গুলি ছোড়েন আনসার সদস্যরা।
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি- শুধু আনসার সদস্যরা নয় ইউএনও নিজেও গুলি ছোড়েন নেতাকর্মীদের ওপর। এ সময় সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ঘটনাস্থলে পৌঁছে সবাইকে নিবৃত করতে গেলে তাকে লক্ষ্য করেও গুলি ছোড়া হয়। এ ঘটনায় কমপক্ষে ৬০ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এদের মধ্যে চোখ হারান তিনজন।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর