সামুদ্রিক মাছে মেশানো হচ্ছে রং

সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে মাছ। সাগর থেকে আনা ট্রলারভর্তি এসব মাছ নামছে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সব মাছ। খানিক পরে সেই মাছ চলে যাচ্ছে খুচরা বাজারে। সেখানে ঝুড়িতে থরে থরে মাছ সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারা কিনছেনও বেশ। তবে এর মধ্যেই ঘটেছে রঙের খেলা। যে রংয়ে মাছ হয়ে গেছে লাল আর তাজা। প্রায় পচে যাওয়া মাছও দেখে মনে হচ্ছে টাটকা।
রং দিয়ে সামুদ্রিক মাছ তাজা করার এমনই চিত্র বাগেরহাটের বিভিন্ন খুচরা বাজারে দেখা গেছে। সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি বিভিন্ন কার্পজাতীয় মাছের ফুলকা বেশি লাল দেখানোর জন্যও রংয়ের ব্যবহার করা হয় এসব মাছ বাজারে।
সরেজমিনে বাগেরহাট শহরের প্রধান মাছ বাজার, দরগা মাজার মোড় মাছ বাজার, যাত্রাপুর বাজার, কচুয়া উপজেলার বাধাল, তালেশ্বর, সাইনবোর্ডসহ জেলার বিভিন্ন সাপ্তাহিক বাজারে মাছের শরীরে রং দিয়ে বিক্রি করতে দেখা গেছে। মাছে রং দিলে তা আকর্ষণীয় আর তাজা দেখায় এবং পচনও রোধ হয় বলে দাবি মাছে রং ব্যবহারকারীদের। এই মাছ খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বলছে সত্যতা পেলে অসাধু ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

গত শুক্রবার (২৭ আগস্ট) সাইনবোর্ড বাজারের মৎস্য বিক্রয় শেডে দেখা যায় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী নানা প্রকারের মাছ নিয়ে বসে আছেন। এর মধ্যে তিন থেকে চার জন রং দেওয়া মাছ বিক্রি করছেন। কেউ কেউ এড়িয়ে যাচ্ছেন রং দেওয়া মাছ। আবার না বুঝে কিনছেনও অনেকে। এদিন একই চিত্র দেখা গেছে শহরের দরগা মাজার মোড় বাজারেও।
এর আগে গত রোববার (২২ আগস্ট) দুপুরে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার বাধাল মাছের বাজারে চোখে পড়ে কয়েকটি ঝুড়িতে সাগরের বাইলা (তুলার ডাডি), জাবা, রয়নাসহ বেশ কিছু রং দেওয়া মাছ ঝুড়িতে সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন ব্যবসায়ীরা। বিক্রিও হচ্ছে।
রং দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে মাছ বিক্রেতা সোহেল বলেন, রং দিলে মাছ একটু ভালো ও তাজা দেখায়। ক্রেতারাও বেশি কেনেন। অল্প পরিমাণে রং দেই। এতে স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয় না বলে দাবি করেন তিনি।
মাছ বিক্রেতা মো. হাফিজ বলেন, বাজারের বড় দোকান থেকে মাছ কিনি। বাজারে এসে রং মিশ্রিত পানির মধ্যে ভিজিয়ে উঠিয়ে ঝুড়িতে রাখি। এতে ক্ষতি হয় কিনা জানি না। ক্ষতি হলে তো দোকানে এই রং বিক্রি হতো না।
মাছে রং দেওয়ার প্রক্রিয়া জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে বড় দোকান থেকে গোপনে প্যাকেটজাত রং ক্রয় করি। ঝুড়ির পাশে লাল রংয়ের বালতিতে পানির সঙ্গে রং মেশানো হয়। পরবর্তীতে ঝুড়িতে মাছ তোলার আগে বালতির মধ্যে ভিজিয়ে মাছগুলো বরফের ওপর রাখি।
মুশফিকুল ইসলাম নামে রং দেওয়া মাছের একজন ক্রেতা জানান, বাজারে এসে যেই মাছ সতেজ ও টাটকা দেখায় সেই মাছই কিনি। মাছে যে রং মেশানো হয় তা তো জানতাম না। তাজা দেখে কিনে তো আরও ক্ষতি হচ্ছে তাহলে। রং মিশিয়ে যারা ক্রেতাদের ঠকায় তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
বাগেরহাট শহরের বাসিন্দা অপর এক ক্রেতা আকবর টুটুল বলেন, শুধু মাছে নয়, সবজি এবং ফলেও অনেক সময় রং দেওয়া হয়। এছাড়া শুধু রং-ই নয়, রঙিন ও উজ্জ্বল বাতির মাধ্যমেও আকৃষ্ট করা হয় ক্রেতাদের। নজরদারি না থাকার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ পায় বলে দাবি করেন তিনি।
বাগেরহাট জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মাছে রং দেওয়ার বিষয়টি এক ধরনের অপরাধ। আমরা পরবর্তীতে বিভিন্ন মাছের বাজার পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

কৃত্রিমভাবে মাছের রং পরিবর্তন করা ভোক্তাদের সঙ্গে এক ধরণের প্রতারণা জানিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতফর বাগেরহাটের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল ইমরান বলেন, প্রতিটি মাছ বাজারে অভিযান চালানো হবে। সত্যতা পেলে অসাধু ব্যবসায়ী ও রং মেশানোর কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাগেরহাট সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রদীপ কুমার বকসী জানান, কৃত্রিম রং মেশানো যে কোনো খাবারই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। রং মেশানো খাবার খেলে মানুষের বুকে জ্বালা, অ্যাসিডিটির সমস্যা, হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা, পেটের পীড়া, মাথা ব্যথাসহ তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদি যে সমস্যাগুলো হতে পারে তার মধ্যে কিডনির সমস্যা অন্যতম। এছাড়া চামড়ায় নানা ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। কৃত্রিম রং, ডালডা ও অতিরিক্ত তেল ব্যবহারে ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি থাকে। উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হরমোন তার ভারসাম্যও হারাতে পারে। স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে মানুষের মধ্যে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগও প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এমডি আক্তারুজ্জামান বলেন, যেকোনো ধরনের রং হচ্ছে কেমিক্যাল। এটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে পাকস্থলি, লিভার, কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। মাছসহ যেসব খাদ্যে রং মিশ্রণের সুযোগ রয়েছে, সেসব পণ্য ক্রয়ে ভোক্তাদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তানজীম আহমেদ/আরএআর