বঙ্গবন্ধুকে দাফনকারী সিরাজুল প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পেতে চান

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দাফনকারী তৎকালীন পুলিশ সদস্য (কনস্টেবল) নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কাজী সিরাজুল ইসলাম (৭৪) প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পেতে চান। এই সাহসী মানুষ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার সামনে বলেছিলেন, ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক মুসলিম রীতিতে বঙ্গবন্ধুকে গোসলসহ দাফন-কাফন করতে হবে।
সোমবার (১৮ জানুয়ারি) বিকেলে ইতনা গ্রামের নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করানোসহ দাফন-কাফনের সেদিনের মর্মস্পর্শী কাহিনিগুলো তুলে ধরেন তিনি।
কাজী সিরাজুল ইসলাম জানান, ১৯৭৫ সালের আগস্টে গোপালগঞ্জ তৎকালীন সাব-ডিভিশন পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) আব্দুল মান্নানের দেহরক্ষী (বডি গার্ড) ছিলেন। তার সদস্য নম্বর ২০৭৩। পুলিশের নতুন পোশাক আনতে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট তিনি ফরিদপুর যান। ওই সময় বেতন, রেশন, কাপড় সবই ফরিদপুর থেকে দেয়া হতো। তিনি বলেন, ওই রাতে খাবার খেয়ে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়েছিলাম। আমাদের কাছে থাকা রেডিও বন্ধ করতে মনে ছিল না। রাত পৌনে তিনটার দিকে রেডিওর খবরে শুনি, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। খবর শুনে ওই সময় পুলিশের পোশাক পরে গোপালগঞ্জের দিকে রওনা দিলাম। অনেক কষ্ট করে ভোরে গোপালগঞ্জের বাসায় এসে পৌঁছালাম। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে এক পুলিশ বাসায় এসে জানালেন, এসডিপিও স্যার দ্রুত ডেকে পাঠিয়েছেন। পোশাক পরে দ্রুত স্যারের কাছে চলে গেলাম।
পরে তখনকার ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের স্যার, এসডিপিও আব্দুল মান্নান স্যার এবং আমি একটি স্পিডবোডে করে টুঙ্গিপাড়ায় যাই। সেখানে গিয়ে থানায় অবস্থান করছিলাম। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ তখনো আসেনি। এরই মধ্যে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর জন্য কবর খোঁড়ার কাজ চলছে। সকাল আনুমানিক ১০টা থেকে ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসা হলো। মরদেহের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একজন মেজর ও সিপাহীকে দেখতে পেলাম। হাসপাতাল ও পুলিশের লোক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মরদেহ তার বাড়িতেই নিয়ে এল। কাঠ দিয়ে তৈরি কফিন খোলার পর দেখা গেল, মরদেহ চা-পাতা আর বরফ দিয়ে ঢাকা। মরদেহ সাদা একটি কাপড় দিয়ে মোড়ানো।
আমি এই কথাগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলতে চাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মরদেহের সঙ্গে করা খুনিদের সেই অন্যায়গুলোর কথা এত দিন ধরে স্মৃতিতে রেখেছি। তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কথাগুলো বলে নিজের মনকে হালকা করতে চাই।
সিরাজুল ইসলাম
তবে এটি কাফনের কাপড় নয়, সাধারণ একটি কাপড়। তখন ওই মেজরের কাছে বললাম, স্যার, মনে হচ্ছে লাশের তো গোসল হয়নি। মেজর সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, কে কার গোসল করাবে? আমি বললাম, মুসলমান হিসেবে তাকে গোসল করাতে হবে। কাফন দিতে হবে। তারপর দাফন করতে হবে। তখন তিনি রেগে গিয়ে বললেন, আপনার বাড়ি কোথায়? তিনি ভেবেছিলেন আমি বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়। বললাম, নড়াইলের লোহাগড়া থানার ইতনা গ্রামে আমার বাড়ি। তিনি বললেন, দেরি করলে লাশ ছিনতাই হয়ে যেতে পারে। বললাম, স্যার, ১৪৪ ধারা জারি আছে। ফোর্স দিয়ে টুঙ্গিপাড়া ঘেরাও আছে। তিনি বললেন, গোসল কে করাবে? কত সময় লাগবে? আমি বললাম, গোসল আমি করাব এবং আধাঘণ্টার মধ্যে হয়ে যাবে। তখন গোসল করানোর অনুমতি দিলেন তিনি।
এ সময় বঙ্গবন্ধুর পরনে ছিল পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। গোসল করানোর সময় বঙ্গবন্ধুর চাচাতো চাচা আব্দুল মান্নান টিনের দুটি পুরোনো বালতি আর সিলভারের একটি বদনা নিয়ে এলেন। গোসল করানোর জন্য আনা হলো ৫৭০ কাপড় কাচার সাবান। তখন এত খারাপ লাগল এই ভেবে যে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করাতে হলো ৫৭০ কাপড় কাচা সাবান দিয়ে! এ কথা চিন্তা করতে দুচোখ দিয়ে পানি এল। জাতির জনককে গোসল করালাম নিজ হাতে। বঙ্গবন্ধুকে গোসল করাতে গিয়ে দেখলাম, বুকের বাঁ পাশে তিনটি গুলির চিহ্ন। আরেকটা গুলি ডান হাতের আঙুলে লেগেছিল। গুলি লেগে আঙুলটি উল্টে গেছে।
গোসলের পর কাফনের কাপড়ের দরকার। তখন ইতনা গ্রামের বাসিন্দা মোকলেছুর ছিলেন টুঙ্গিপাড়া থানার সেকেন্ড অফিসার। তিনি বললেন, আমি কাফনের কাপড় নিয়ে আসছি। কাফনের জন্য যে কাপড় পাওয়া গেল, সেটি মার্কিন থান কাপড়। এটি রিলিফের কাপড়। কাপড় জোড়া দিয়ে কাফনের কাপড় প্রস্তুত করা হলো। কাফন দেওয়ার সময়ও বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। কয়েকবার রক্ত পরিষ্কার করার পর কাফন করলাম।
এরপর জানাজা অনুষ্ঠিত হলো। জানাজায় ২০ থেকে ২৫ জন লোক ছিলাম। পুলিশ স্টাফ আর হাসপাতালের লোক জানাজায় অংশ নিলেন। জনসাধারণকে জানাজায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। জানাজা শেষে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ দাফনের জন্য কবরের কাছে নিয়ে এলাম। জাতির জনকের মরদেহ আমি নিজ হাতে কবরে রেখেছি। কবরে বাঁশের স্তর দিয়ে ঢেকে দেব। এমন সময় কয়েকজন মহিলা ওই মেজরের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করছেন এই বলে যে তাদের যেন একবার বঙ্গবন্ধুর মুখটা শেষবারের জন্য দেখতে দেওয়া হয়।
এ সময় মেজর বললেন, না, এখন দেখানো যাবে না। তখন আমি তাদের বললাম, আপনাদের বাড়ি কোথায়? তারা জানালেন, বাড়ি কাউলিপাড়া। তখন আমি বললাম, স্যার, ১০ থেকে ১২ মাইল রাস্তা পার করে এরা কষ্ট করে এসেছে চোখের দেখা দেখতে। তখন মেজর বললেন, কে দেখাবে? বললাম আমি দেখাব। মেজর আমার ওপর আবার খেপে গিয়ে বললেন, আপনি তো আচ্ছা লোক। লাশ আসার পর থেকে এর পেছনে লেগেই আছেন। তখন আমি আবার কবরে নেমে তাদের লাশের মুখ দেখালাম। তারা বঙ্গবন্ধুর মুখ দেখেই হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন।
আজকের এই সংবাদ সম্মেলন কেন, এমন প্রশ্নে সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি এই কথাগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলতে চাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মরদেহের সঙ্গে করা খুনিদের সেই অন্যায়গুলোর কথা এত দিন ধরে স্মৃতিতে রেখেছি। তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কথাগুলো বলে নিজের মনকে হালকা করতে চাই।
এ সময় সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আলী আজগর রাজা, শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস, কাজী সিরাজুল ইসলামের বাল্যবন্ধু কাজী বাবুল হোসেন, তার বড় ছেলে শরিফুল ইসলাম, শিকদার ফারুক হোসেন, কাজী শরাফত হোসেনসহ গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
এনএ