পুলিশের চাকরি পেয়ে তাদের চোখে আনন্দাশ্রু

বৃহস্পতিবার (০৪ অক্টোবর) রাত সোয়া ১২টা। ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন্স চত্বরে পুলিশ ট্রেইনি রিক্রুটিং কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করছিলেন জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহা. আহমার উজ্জামান।
তার ঠিক সামনেই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে অধীর আগ্রহে শুনছিলেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। মাইকে তখন উত্তীর্ণদের রোল নম্বর ও নাম ঘোষণা করছিলেন জেলা পুলিশের এ শীর্ষ কর্মকর্তা।
একেকটা রোল ঘোষণা করা হচ্ছিল আর সঙ্গে সঙ্গেই উত্তীর্ণদের উত্তর ‘ইয়েস স্যার’। চূড়ান্ত তালিকা থেকে ঘোষণা করা নিজের নামটি শোনার পরপর অনেকেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন। এ সময় আনন্দাশ্রু যে শুধু চাকরিপ্রার্থীরই ছিল তা কিন্তু নয়, এমন খবরে ছেলে-মেয়েকে জড়িয়ে অশ্রুভেজা চোখেই উচ্ছ্বাস করতে দেখা গেছে অনেক বাবাকে।
ময়মনসিংহ সদরের দাপুনিয়া গ্রামের দিনমজুরের ছেলে আলমগীর হোসেন। পুলিশে চাকরি করা স্বপ্ন ছিল তার। তবে স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল দরিদ্রতা। বাবা বিল্লাল হোসেনের যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা সেখানে চাকরি যেন ছিল সোনার হরিণ।
তবে আলমগীর জানতে পারেন পুলিশে চাকরি পেতে লাগে না কোনো বাড়তি টাকা। মেধা যোগ্যতা হলেই মোট ১৩৩ টাকা খরচ করেই মিলবে পুলিশের চাকরি। পরে আবেদন ফরম পূরণ করে লাইনে দাঁড়ালেন। এরপর সব বাছাইয়ে মেধা ও যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হলেন আলমগীর। এখন তিনি বাংলাদেশ পুলিশের গর্বিত একজন সদস্য।
ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পর বাবাকে ধরে কেঁদে ফেলেন আলমগীর। অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। দিনমজুর বাবার দরিদ্র পরিবারে ছেলে আমি। তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পারি না। আমার তো লোক ধরার কোনো সুযোগ নাই। সেখানে আমি টিকে গেছি। নিয়োগে স্বচ্ছতা না থাকলে এটা সম্ভব হত না।
আলমগীরের বাবা বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আমি খুব গরিব। পরনের লুঙ্গিটাও দেহুইন ছিড়া। কাম কইরা কোনোরহমে খাই। কিন্তু আমার পুলাফানরে আমি কাম করাইছি না, লেহাপড়া করাইছি। আমি কইছি তোমরা লেহাপড়া করো আর আমি কাম করি। আমার পুলা পুলিশে টিকছে। আমি খুশিতে বেহুঁশ অইয়া যাইতাছি। আমার জীবনে এত খুশি আর কোনোদিন অই নাই।’
দিনমজুর নজরুল ইসলামের মেয়ে সানজিদা। বাড়ি গৌরীপুরের ভাংনামারী গ্রামে। এক বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। পড়াশোনা করছেন ময়মনসিংহ নগরীর মুসলিম গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে। দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে এতদূর এসে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয় টিউশনি করে।
আজ তার সেই কষ্ট ঘোচানোর দিন। চূড়ান্ত নিয়োগ তালিকায় এসেছে তার নাম। বৃহস্পতিবার (০৪ নভেম্বর) চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার নিজের নামটি শোনার পর চোখ অশ্রুতে ভরে যায় সানজিদা ও তার বাবা নজরুলের।
অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে সানজিদা বলেন, আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাতজন। বাবা ছাড়া পরিবারে উপার্জনক্ষম কোনো ব্যক্তি নেই। তাই আমার চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ঘুষ ছাড়া কোথায় চাকরি পাবো, এমন চিন্তা মাথা থেকে দূর হচ্ছিল না।
তবে জানতে পেরেছি কোনো ধরনের তদবির ছাড়াই পুলিশে চাকরি হয়। তাই আবেদন করে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়েছি। অবশেষে সেটিই সত্য হল। আবেদন ফরম ৩ টাকা, ব্যাংক ড্রাফট ১০০ টা ও অনলাইন চার্জ ৩০ টাকা দিয়েই পেয়ে গেছি কাঙ্ক্ষিত পুলিশের চাকরি। এখন আমিই সংসারের হাল ধরতে পারব বলে জানান তিনি।
আলমগীর, সানজিদার মতোই মোট ১০৭ জন শুধু মেধা ও যোগ্যতায় মাত্র ১৩৩ টাকায় পুলিশে চাকরি পেয়েছেন। যাদের কারো বাবা কৃষক, কারো বাবা দিনমজুর-শ্রমিক, কারো বাবা রিকশাচালক, কেউবা আবার নিজেরাই গার্মেন্টসকর্মী।

জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে এবার ২৯৩০ জন পরীক্ষার্থী শারীরিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে এ পরীক্ষায় ৭১৬ জন উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরে লিখিত পরীক্ষায় পাস করে ১৮৫ জন। এর মধ্যে থেকে ১৯ জন অপেক্ষমাণসহ ১২৬ জন উত্তীর্ণ হয়। যার মধ্যে ১০৯ জন পুরুষ ১৭ নারী।
জেলার পুলিশ সুপার মোহা. আহমার উজ্জামান ফলাফল ঘোষণার পর বলেন, আমি অভিভূত এবং নিজেকে গর্বিত মনে করছি ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে পেরে। আইজিপি মহোদয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও চেষ্টার কারণেই শতভাগ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে যোগ্যতাভিত্তিক এ নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম প্রতিরোধে নিয়োগ পরীক্ষার আগে থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা সতর্ক ছিলাম। দালালরা যাতে প্রার্থীদের প্রতারিত করতে না পারে, সেজন্য গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল মাঠে কাজ করেছে। আমরা বিশ্বাস করি এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা যে পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ দিলাম তারা ২০৪১ এর উন্নত বাংলাদেশের পুলিশ হিসেবে নিজেদের তৈরি করতে পারবে।
এমএসআর