গাংনীতে জোড়া খুনের ঘটনায় পুরুষশূন্য ধলা গ্রাম, হয়নি মামলা

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাথুলী ইউনিয়নের ধলা গ্রামে জোড়া খুনের ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। গ্রাম ছেড়েছে ঘটনায় জড়িতরা। গ্রেফতার ও পুলিশি হয়রানি এড়াতে অনেক সাধারণ মানুষও গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। তবে পুলিশ বলছে- অহেতুক কেউ হয়রানির শিকার হবে না। দোষীদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করা হবে।
সরেজমিনে উপজেলার ধলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে সুনসান নীরবতা। চায়ের দোকান ও রাস্তাঘাট নেই কোনো মানুষ। নিহতদের বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে স্বজনদের কান্না আর আহাজারির আওয়াজ। কয়েকটি জায়গায় বাড়ির সামনে বৃদ্ধ নারী ও শিশুদের দেখা মেলে। তাদের চোখে জল, মুখে আতংকের ছাপ। তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলেও মুখ ফিরিয়ে নেন। স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে চেপে তারা প্রহর গুনছেন দোষীদের গ্রেফতার ও শাস্তির।
গত সোমবার (৮ নভেম্বর) সকাল ৯টার দিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দুই মেম্বার প্রার্থী আজমাইন হোসেন টুটুল (বর্তমান মেম্বার) ও উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিয়ার রহমান সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে টুটুলের চাচাতো দুই ভাই সাহাদুল ইসলাম ও জাহারুল ইসলামকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে আতিয়ার রহমানের লোকজন। এ ঘটনায় মেম্বার প্রার্থী টুটুল ও নারীসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। আহতদের কুষ্টিয়া ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনার পর নিহতদের বাড়িও পুরুষ শূন্য। তবে গ্রামে পুলিশ, র্যাব ও ডিবি পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। গতকালই তাৎক্ষণিকভাবে ১২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে গাংনী থানায় নেওয়া হয়। মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আটকদের থানা হেফাজতেই রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আজমাইন হোসেন টুটুলের বোন সুচিন্তারা বলেন, ২০১০ সালে আতিয়ার রহমানের লোকজন অতর্কিত হামলা চালিয়ে টুটুলের ভাই সেন্টুকে কুপিয়ে হত্যা করে। সেন্টু হত্যা মামলাটি আপস মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১৭ সালে মেজো ভাই এনামুল হক নইলুকে নবীনপুর রাস্তায় একা পেয়ে আতিয়ার রহমান ও তার লোকজন কুপিয়ে হত্যা করে। সেই হত্যা মামলায় আতিয়ার রহমানকে প্রধান আসামি করে আদালতে হত্যা মামলা করা হয়। মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। বিগত ইউপি নির্বাচনে মেম্বার পদে অংশগ্রহণ করে আমার ভাই টুটুলের সঙ্গে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়। এবারও তারা দুজনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
ভোট চাওয়াকে কেন্দ্র করে গতকাল সকালে আতিয়ার রহমান ও তার লোকজন টুটুলের লোকজনের ওপর আতর্কিত হামলা করে। এ হামলায় আমার আপন চাচাতো দুই ভাই সাহাদুল ও জাহারুল নিহত হয়। আতিয়ার বাহিনীর হাতে একই বংশের ৪ জন খুনের ঘটনায় পুরো পরিবারই ধ্বংসের মুখে। তবে এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি বলেও জানান তিনি।

নিহত জাহারুলের বোন রেক্সোনা খাতুন বলেন, জাহারুলের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে শাকিল আহমেদ বিদেশ থাকে। মেয়ে চম্পা অনার্স পড়ছে। সাহাদুলের এক ছেলে জাহিদুল ও এক মেয়ে সুবর্ণা। জাহিদুল বিদেশ থাকে এবং সুবর্ণা স্বামীর সংসারে। পরিবারের সবাই আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় এখনো মামলা করা হয়নি। এছাড়া আমরা এখন রাস্তায় বের হতে পারছি না। কারণ আতিয়ারের লোকজন এলাকাতেই আত্মগোপনে আছে। যে কোনো সময় আবারও আমাদের ওপর হামলা চালাতে পারে এমনকি বাড়িঘর লুট করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, একে একে আমার চারটি ভাই আতিয়ারের হাতে খুন হলো। সে জামিনে এসে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। আবারও আমার দুই ভাইকে খুন করল। আমরা তার ফাঁসি চাই। আতিয়ার ও তার লোকজনকে দ্রুত গ্রেফতার করা না হলে আমাদের ওপর আবারও হামলা চালাতে পারে।
কয়েকজন প্রতিবেশী বলেন, নিহতদের পরিবারের আহাজারিতে এলাকার আকাশ ভারি হয়ে উঠেছে। যে দিকে তাকাই শুধু শোক আর শোক।
গাংনী থানার ওসি (তদন্ত) শাহ আলম জানান, নিহত দুইজন সাহাদুল ও জাহারুলের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পারিবারিকভাবে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বজলুর রহমান জানান, নিহতদের আপনজনেরা বিভিন্ন হাসপাতালে থাকায় এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে মামলা হলে জানানো হবে। আটকদের বিষয়ে তিনি জানান, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
মেহেরপুরের পুলিশ সুপার রাফিউল আলম জানান, গাংনীর ধলা গ্রামের দুই খুনের ঘটনায় নতুন করে আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সেখানে পুলিশি পাহারা জোরদার করা হয়েছে। তবে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই আতংকে পুরুষ শূন্য হয়ে পড়ে এলাকা। সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানি না হয় সে বিষয়ে পুলিশ সজাগ রয়েছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।
আকতারুজ্জামান/আরএআর