পেশা বদল করছেন যাত্রাশিল্পীরা

ভালো নেই নেত্রকোনার যাত্রাশিল্পীরা। চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে জেলার শতাধিক যাত্রাশিল্পী বর্তমানে অসহায় দিন কাটাচ্ছেন। জীবিকা চালাতে অনেকেই বহুদিনের পুরোনো এ পেশা ছেড়ে নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন অন্যান্য কাজে।
যে শিল্পীরা মঞ্চে রাজা-রাণী ও সেনাপতির অভিনয়ের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতিসহ প্রেম-বিরহ ও ইতিহাসের নানা দিক তুলে ধরতেন, আজ বাস্তবে তাদের কেউ রাস্তায় চালাচ্ছেন রিকশা, কেউ হয়েছেন সেলুন কর্মী। গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছেন কেউ কেউ। আবার কাউকে করতে হচ্ছে গৃহকর্মীর কাজ। এ সবই যেন তাদের নিয়তি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লোকসাহিত্যে সমৃদ্ধ নেত্রকোনা জেলা যাত্রাশিল্পের জন্যও প্রসিদ্ধ। সারা দেশে ছড়িয়ে আছে এখানকার শিল্পীদের সুনাম। তাই স্থানীয় শিল্পীদের পাশাপাশি এক সময় খুলনা, বাগেরহাট ও গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার যাত্রাশিল্পীরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাদের নিয়ে জেলা শহরের সাতপাই রেলক্রসিং এলাকায় গড়ে ওঠে একটি যাত্রাপল্লী। এর বাইরে জেলার মোহনগঞ্জ, কেন্দুয়া, বারহাট্টা, মদন ও আটপাড়াসহ ১০ উপজেলাতেই যাত্রার প্রচুর শিল্পী ও কলাকুশলী ছড়িয়ে আছেন- যারা এটিকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা সাড়ে তিনশর বেশি। এদের মধ্যে নারী শিল্পী রয়েছে প্রায় ১২০ জনের মতো। এর বাইরে পাঁচ শতাধিক অপেশাদার শিল্পীও আছেন জেলার গ্রামগঞ্জে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের নেত্রকোনা জেলা শাখার সভাপতি মো. দিদারুল ইসলাম জানান, নেত্রকোনায় বন্ধন অপেরা, ঝলমল অপেরা, নেত্রকথন নাট্য গোষ্ঠী ও কৃষ্ণা অপেরা নামে চারটি নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যাত্রাদল আছে। এসব দল সারাবছর বিভিন্ন জেলায় গিয়ে যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করত। একেকটি দলে ৪০ থেকে ৫০ জন করে শিল্পী ও কলাকুশলী মাসিক বেতনে চাকরি করতেন। এদের মধ্যে অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়াও পরিচালক, নির্দেশক, বাদ্যযন্ত্রী, প্রম্পটার (স্মারক), বিবেক, মেকাপম্যান, শব্দ নিয়ন্ত্রক, বিদ্যুৎ মিস্ত্রি, বাবুর্চি ও হেল্পার রয়েছেন।
এদিকে ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর সরকার সব ধরনের জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ কারণে অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির মতো যাত্রাপালাও বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত দুর্গোৎসবের সপ্তমী পূজার দিন থেকে যাত্রার মৌসুম শুরু হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার কোনো দলই কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
এদিকে যাত্রাশিল্পকে কেন্দ্র করে জেলা সদরের সাতপাই, মোহনগঞ্জ ও কেন্দুয়া উপজেলায় ১২-১৩টি সাজঘরের (ড্রেস হাউস) ব্যবসা ছিল। এসব সাজঘর থেকে ভাড়া দেওয়া হতো বাদ্যযন্ত্র, বাদ্যযন্ত্রী, পোশাক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ যাত্রাপালায় প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সরঞ্জামাদি। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বেশিরভাগ সাজঘরের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। আটকে গেছে অনেকের ঘরভাড়া। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন এসব ব্যবসায়ী।
জেলার কেন্দুয়া পৌর শহরের রহিম সাজঘরের মালিক আব্দুর রহিম বলেন, করোনার কারণে যাত্রা-নাটক বন্ধ থাকায় আমাদের ব্যবসাও বন্ধ। কয়েক লাখ টাকার মালামাল ঘরে পড়ে আছে। সরকারি সহযোগিতা না পেলে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো একেবারেই অসম্ভব। ব্যবসা বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এছাড়াও কাজ না থাকায় বেশিরভাগ যাত্রাশিল্পীও এখন বেকার দিন কাটাচ্ছেন। জীবন চালানোর তাগিদে অনেকেইে জড়িয়ে পড়ছেন বিকল্প পেশায়।
শহরের সাতপাই এলাকার চন্দন সরকার আগে যাত্রাদলে নায়কের অভিনয় করতেন। কিন্তু যাত্রা বন্ধ থাকায় তিনি এখন রেলক্রসিং বাজারে চালের ব্যবসা করছেন। একই এলাকার বাদ্যযন্ত্রী পরিমল সরকার এবং নিধু দাস রিকশা চালাচ্ছেন। কাজল চন্দ্র শীল নামে এক যাত্রাশিল্পী চুল-দাড়ি কাটার কাজ নিয়েছেন একটি সেলুনে। হরিচরণ দাস শুরু করেছেন চায়ের দোকান।
রাহুল চক্রবর্তী নামে একজন ড্রামবাদক বলেন, টাকা-পয়সার অভাবে বাড়ির এক অংশ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছি।
পুরুষ শিল্পীরা বিকল্প কিছু কাজ পেলেও নারী শিল্পীরা পড়েছেন সবচেয়ে বেকায়দায়। তারা কোনো কাজই পাচ্ছেন না। তাদের অধিকাংশই বেকার। তবে জীবিকার তাগিদে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে গৃহকর্মীর কাজ করছেন। অনেনেই গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী শিল্পী বলেন, বেকার হওয়ার পর বেশ কিছু টাকা ঋণ করে ফেলেছি। তাই এখন নিরুপায় হয়ে স্থানীয় একটি ছাত্রদের মেসে রান্না-বান্না করে দিন পার করছি।
এ নিয়ে কয়েকজন প্রবীণ যাত্রাশিল্পীর সাথে কথা হয়। তারা জানান, শীত মৌসুম যাত্রাপালার জন্য একটি মোক্ষম সময়। প্রতি বছর এ সময়টিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় মাস বা পক্ষকালব্যাপী প্যান্ডেল করে যাত্রাপালাার আয়োজন করা হত। এ কারণে শীতকালে খুব ব্যস্ত সময় পার করতে হত যাত্রার কলাকুশলীদের। কিন্তু এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে কোথায়ও যাত্রাপালার আয়োজন সম্ভব হয়নি। ফলে আশা ভেঙেছে প্রত্যেকের। এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন বলেও জানান তারা।
তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকার শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য প্রচুর বরাদ্দ দিলেও তা মাঠ পর্যায়ে যথাযথভাবে বিতরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে যাত্রাশিল্পীদের।
বর্তমানে নেত্রকোনার স্বনামধন্য যাত্রানায়িকা ও পালাকার প্রিন্সেস বিউটি বলেন, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে যারা এসব সরকারি সহায়তা বা প্রণোদনা বিতরণ করেছেন- তারা পেশাদার বা প্রকৃত যাত্রাশিল্পীদের মোটেই গুরুত্ব দেননি। তারা যাদের সহযোগিতা করেছেন-তাদের ৯৫ ভাগই অপেশাদার বা সৌখিন শিল্পী।
বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ নেত্রকোনা জেলা শাখার সাবেক সহ সভাপতি ভক্ত দাস বলেন, মাত্র ৫৫ জন শিল্পী এক হাজার টাকা করে এবং ৪১ জন শিল্পী পাঁচ হাজার টাকা করে সরকারি সহায়তা পেয়েছেন। কিন্তু যারা এ তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন তারাও বেশিরভাগই দুঃস্থ শিল্পী। যাত্রাজগতে সচ্ছল শিল্পীর সংখ্যা খুবই কম।
এসব বিষয়ে নেত্রকোনা জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, যাত্রাশিল্পীদের দুরবস্থার বিষয়ে আমি অবগত। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব। করোনাকালীন সহায়তা বিতরণের সময় আমরা এবং জেলা প্রশাসন যাদের কথা জানতে পেরেছি অথবা যারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তাদের প্রত্যেকের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।
জিয়াউর রহমান/আরএআর