আছপিয়া-সজল-মিমের পুলিশে প্রশিক্ষণের সুযোগে আশায় ভূমিহীন হাসান

ধর্মান্তরিত হওয়ায় উত্তরাধিকারের ভূমি থেকে বঞ্চিত হন হাসান সিদ্দিকীর বাবা। পরবর্তীতে তার দাদা সব জমি বিক্রি করে দেন। ভূমিহীন হয়েও পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরির আশায় দরখাস্ত করেন তিনি। অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা না দিয়ে চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন হাসান। মেধা তালিকায় ১১৫তম হয়ে সকল ধাপে সফলও হন তিনি। নেওয়া হয় পুলিশের পোশাক ও জুতার পরিমাপ। কিন্তু কোভিড পরীক্ষার জন্য ডাক না পেয়ে জানতে পারেন ভূমিহীন হওয়ায় তার আর চাকরি হচ্ছে না।
শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) সাভারের বিনোদনবাইদ এলাকার রাব্বি ভিলায় হাসান সিদ্দিকীর সঙ্গে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, আমি প্রথম ভেরিফিকেশনেই বলেছি আমাদের কোন ভূমি নেই। তারপরও পরবর্তী ধাপে অংশগ্রহণের জন্য আমাকে ডাকা হয়। এক্ষেত্রে ভূমিহীনের সনদ জমা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ সময় উপজেলা ভূমি অফিস থেকে সেসব সংগ্রহ করে জমাও দেই। কিন্তু শেষ সময়ে এসে আমি পুলিশ লাইন্সের রিজার্ভ অফিসে গিয়ে জানতে পারি ভূমি না থাকার কারণে আমার চাকরি হচ্ছে না। আমি হতাশ হয়ে পড়েছি।
বর্তমানে সাভারের বিনোদবাইদ এলাকার বাবুল আহমেদের টিনশেড বাসায় পরিবারের সঙ্গেই ভাড়া থাকেন হাসান সিদ্দিকী। তিনি সাভার মডেল একাডেমি থেকে ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। ২০১৯ সালে সাভার মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন ধামরাই সরকারি কলেজে। বাবা ওমর সিদ্দিকী চিত্রগ্রাহকের কাজ করে সংসার চালান কোনো মতে। পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে পুলিশ কনস্টেবলে চাকরির দরখাস্ত করেন হাসান।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকা জেলায় পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি দেখে অনলাইনে আবেদন করে ১৪ নভেম্বর গেণ্ডারিয়া সদরঘাটে পুলিশ মিল ব্যারাকে শারীরিক যোগ্যতা পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। চলে ১৫ ও ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত। এখানে কৃতকার্য হয়ে ১৭ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষায় ও ২৪ নভেম্বর একই জায়গায় মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় ১১৫ তম হন। গত ২৯ নভেম্বর প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ৩ ডিসেম্বর রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগের জন্য সাভার মডেল থানা পুলিশ, এনএসআই ও ডিএসবির ভেরিফিকেশন হলে সেখানেই ভূমি না থাকার বিষয়টি জানান হাসান।
হাসান সিদ্দিকী বলেন, আমার সঙ্গে যারা কৃতকার্য হয়েছে তাদের সবাইকে কোভিড পরীক্ষার জন্য ডাকা হয় পুলিশ কেন্দ্রীয় মিল ব্যারাক হাসপাতালে। কিন্তু তার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। বিষয়টি জানার জন্য অন্যদের সঙ্গে গত বুধবার (২৯ ডিসেম্বর) আমি রাজারবাগ পুলিশ কেন্দ্রীয় হাসপাতালে গেলে বলা হয়- ‘কেন এসেছেন। আপনাকে তো ডাকা হয়নি।’ কেন ডাকা হয়নি জানতে চাইলে আমাকে রিজার্ভ অফিসে ডেকে নিয়ে জানানো হয়, ভূমিহীন হওয়ায় আমাকে নেগেটিভ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের সব ধাপ শেষ হওয়ার পর আমার কাছ থেকে পোশাক ও জুতার পরিমাপ জানার জন্য ফোন করা হয়। তারপরও আমার চাকরি না হওয়ার খবর শুনে হতাশ হয়ে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যাই। কিন্তু তাকে না পাওয়ায় বিষয়টি আর জানানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু উপস্থিত সবার মুখে একই কথা, জমি ছাড়া চাকরি হবে না। পরে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরে আসি।
হাসান সিদ্দিকী বলেন, আমার বাবা ধর্মান্তরিত হওয়ার পর সব কিছু থেকে বঞ্চিত হন। তিনি চিত্রগ্রাহকের কাজ করে অনেক কষ্টে আমাকে ও আমার ছোট ভাইকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তার কষ্ট দেখে প্রায়ই গোপনে কাঁদতে হয়। তার কষ্ট লাঘবে লেখাপড়া শেষ করার আশা ছেড়ে দিয়ে চাকরির জন্য দরখাস্ত করি। তবে শেষ সময়ে এসে ভূমি না থাকায় স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই- অন্য তিনজনকে (আছপিয়া, সজল ও মিম) যেভাবে চাকরি দিয়েছেন সেভাবে যেন আমাকে চাকরিটা দেন। আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ভূমিহীন হলে সেই সার্টিফিকেট জমা হলেই আমরা চাকরি দিচ্ছি। চাকরি হবে, এ রকম তিনজনকে আমরা নিয়োগ দিয়েছি। ইউএনওর কার্যালয় বা ভূমি কার্যালয় থেকে প্রত্যয়নপত্র দিলেই আমরা নিয়োগ দেব।
তবে হাসানের দাবি এ সংক্রান্ত সনদপত্র তিনি জমা দিলেও তার নিয়োগ হচ্ছে না। তিন মাস পর আবার নিয়োগ দেওয়া হবে। সেসময় বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, পুলিশ কনস্টেবল পদে সব ধাপে কৃতকার্য হয়েও ভূমি না থাকা বরিশালের আছপিয়া ইসলাম, বরগুনার সজল ও খুলনার মিমকে প্রশিক্ষণে না ডাকায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। পরবর্তীতে তাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়। তাদের সুযোগ দেওয়ায় এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন হাসান সিদ্দিকী।
মাহিদুল মাহিদ/আরএআর