ঠান্ডাত জীবনটা ব্যাড়ে যাওচে

রংপুরে ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় কাহিল জনজীবন। তিস্তা-ঘাঘট, করতোয়া-যমুনেশ্বরী নদীবেষ্টিত এ জেলার প্রকৃতি ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে। ভোরে সূর্যোদয় হলেও কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে নিখোঁজ রয়েছে আলোর ঝলকানি। সকাল পৌনে ১০টা পর্যন্ত কুয়াশার কারণে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি।
মঙ্গলবার (০৪ জানুয়ারি) মধ্যরাত থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত রংপুরের গ্রাম-গঞ্জ আর শহরের পথঘাট ছিল কুয়াশায় ঢাকা। শহরের পিচঢালা সড়কগুলোও ভিজেছে শিশিরবিন্দুতে। গাছগাছালি ভরা সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিও কুয়াশায় ধোঁয়াচ্ছন্ন।
এ অবস্থায় ভোর থেকে সড়ক-মহাসড়কে ছোট-বড় যানবাহনকে চলাচল করতে হচ্ছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। দুর্ঘটনা এড়াতে রেলপথেও গতি কমেছে ট্রেনের। ঘন কুয়াশার কারণে ট্রেনের শিডিউল নড়বড়ের শঙ্কা রয়েছে। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেই বাড়ছে শীতের তীব্রতা। চার দিন ধরে হিমেল বাতাস অব্যাহত থাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছিন্নমূল মানুষেরা চরম বিপাকে পড়েছেন।

এদিকে মঙ্গলবার ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত রংপুর নগরের শাপলা চত্বর, আদর্শপাড়া, মাস্টারপাড়া, কামারপাড়া, লালবাগ, দর্শনা ও দেওডোবা বড়বাড়িসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঘন কুয়াশার দাপটে সড়কে মানুষের উপস্থিতি কম। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে বের হওয়া কর্মজীবী মানুষ ও শিক্ষার্থী অভিভাবকদের দেখা গেছে। তাদের কষ্ট বেড়েছে সড়কে নিত্য চলাচলের বাহন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কম থাকায়। কোথাও কোথাও তাদের গুনতে হয়েছে বাড়তি ভাড়া।
সকাল ৮টার দিকে দর্শনা সড়কের বিএনসিসি মোড় এলাকায় কথা হয় অটোরিকশাচালক আবুল মিয়ার সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কয়দিন ধরি তেমন কামাই নাই। ছোইল-পোইল (সন্তানদের) নিয়ে খুব কষ্টে আছি। ঠান্ডার কারণে কোনো যাত্রী ইসক্যাত (রিকশা) উঠিবার (উঠতে) চায় না। যাত্রী মিললেও ফির ভাড়া নিয়্যা ক্যাচাল (ঝামেলা) নাগে। প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা ভাড়া মারি। কিন্তু ৩-৪ দিন ধরি সারা দিনে মোটে ২০০ টাকাও ভাড়া হওচে না। ঠান্ডাত ইসক্যা চালাইলে মনে হয় জীবনটা ব্যাড়ে যাওচে।
বড়বাড়ি টার্মিনাল রোডে কথা হলে মোটরসাইকেলচালক ইফতেখারুল আলম জানান, ঘন কুয়াশার কারণে মোটরসাইকেলে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ১০ কিলো রাস্তা আসতে প্রায় আধা ঘন্টারও বেশি সময় লাগল। হেডলাইট জ্বালিয়েও কুয়াশায় ঠিকভাবে রাস্তা দেখা যায় না।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মঙ্গলবার রংপুরে সকাল ৯টা পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ১০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া তেঁতুলিয়াতে ৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। তবে সকাল পৌনে ১০টা পর্যন্ত সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। সোমবারের চেয়ে আজ তাপমাত্রা কমেছে সঙ্গে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়েছে। কুয়াশার ঘনত্বও কমেনি।
গতকাল রংপুরে ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। হিমেল বাতাস আর ঘন কুয়াশা শীতের তীব্রতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে জানুয়ারিতে তিনটি শৈত্যপ্রবাহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান এই আবহাওয়াবিদ।
এদিকে ঘন কুয়াশার সঙ্গে হিমেল হাওয়া ছিন্নমূল অসহায় মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও এই কুয়াশা মনে করে দিচ্ছে শৈত্যপ্রবাহের কথা। এছাড়া জানুয়ারিতে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে এবং নদ-নদী অববাহিকায় মাঝারি বা ঘন কুয়াশা এবং অন্যত্র হালকা বা মাঝারি কুয়াশা পড়তে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। ঘন কুয়াশা পরিস্থিতি কখনো কখনো দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
তাছাড়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আরও বলা হয়েছে, জানুয়ারি সবচেয়ে শীতল মাস। এই সময়ে দেশের তাপমাত্রা সবচেয়ে কম থাকে। এ মাসেই কয়েকটি শৈত্যপ্রবাহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ তিনটি শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে। এর মধ্যে একটি তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। এ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে।

এদিকে শীতজনিত নানা রোগ নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে উত্তরাঞ্চলের বহু মানুষ প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসছেন। এর মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধ বেশি। পাশাপাশি আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণে চেষ্টা করা অনেকেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হচ্ছেন।
শীতের কবল থেকে রক্ষা পেতে খড় জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে গত সাত দিনে রংপুর অঞ্চলে শিশুসহ অন্তত ২০ জন দগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে ১৭ জন গুরুতর অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া শীতজনিত রোগে শিশু ও বয়স্কও বেশি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
এমন ঘন কুয়াশা পড়লে কৃষিতে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন এ অঞ্চলের কৃষক। বরাবরই শীতে বোরো বীজতলা ও রবি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে কোল্ড ইনজুরি ও পচনসহ মড়ক বেড়ে যায়। তবে এ ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও করণীয় সম্পর্কে তাদের অবগত করছে কৃষি বিভাগ। এছাড়াও উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানান রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল।
এদিকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ ব্যাপারে রংপুরের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. রাসেল মিয়া বলেন, শীতের শুরুতেই রংপুরে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫২ হাজার ৬০০ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের জন্য পাওয়া ১ কোটি ১০ লাখ ৯৩ হাজার টাকা থেকে শীতবস্ত্র ক্রয় করে বিতরণ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি