ফুলের রাজধানীর ফুলচাষিরা মহাব্যস্ত

মাঘের শীতের মিষ্টি রোদে উত্তাপ গায়ে মেখে রক্তিম ফুলে সেজেছে যশোরের গদখালীর বাহাদুরের জারবেরা শেড। দেড় বিঘা জমিতে দোল খাচ্ছে টুকটুকে লাল, কমলা, হলুদ রঙের জারবেরা। দীর্ঘ আট মাস করোনার প্রাদুর্ভাব আর আম্পানের থাবায় ধূসর হওয়া জমিতে নতুন রূপে ফোটা ফুলের দোলে রং লেগেছে বাহাদুরের মনে। তাই তো ফুলের হাসি তার চোখেমুখে।
আর এই হাসি নিয়েই ফুলে রঙে রঙিন স্বপ্ন দেখতে ফুল পরিচর্যায় ব্যস্ত তিনি। করোনা ও আম্পানের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় তার এ হাজারো ব্যস্ততা। শুধু বাহাদুর নন, রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ফুল পরিচর্যায় মহাব্যস্ত ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালী-পানিসারার হাজারো ফুলচাষি।
ফুলচাষিরা জানান, ‘ফুলের রাজধানী’ গদখালীর চাষিরা মূলত বিভিন্ন দিবসের দিকে চেয়ে থাকেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে গেল বছর কোনো ব্যবসা করতে পারেননি। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে লন্ডভন্ড হয়ে যায় তাদের সব ফুলখেত ও খেতের শেডগুলো। ফুল বেচাবিক্রি না হওয়ায় আগত্যা গরু-ছাগলকে ফুল ও ফুলগাছ খাইয়ে দিয়েছিলেন তারা। এভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হন এ অঞ্চলের ফুলচাষিরা।
তাদের অনেকেই ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতেও তারা তেমন কোনো সরকারি সহায়তা পাননি। যারা পেয়েছেন, চাহিদার চেয়ে অপ্রতুল। সব মিলিয়ে চরমভাবে ভেঙে পড়েন ফুল চাষের ওপর নির্ভর এলাকার হাজারো মানুষ। নিজেদের মরিয়া টেষ্টায় ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন তারা। আসছে পয়লা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ বিশেষ দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে যশোরের গদখালীর ফুলচাষিরা নানা জাতের বাহারি ফুল উৎপাদন ও পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
তবে, করোনার কারণে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে চাষিদের কপালে। নভেম্বর থেকে ফুল বেচাকেনার মৌসুম শুরু হলেও দেশের সবচেয়ে ফুলের পাইকারি বাজার ঝিকরগাছার গদখালীর বাজার এখনো স্বাভাবিক হয়নি ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিধিনিষেধ আরোপ করায় কমেছে এই পাইকারি বাজারের ফুলের বেচাকেনা। কেননা ফুলের চাহিদার ওপর নির্ভর করে কৃষকদের ফুল উৎপাদন। এমন পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জাতীয় সব অনুষ্ঠান করায় সরকারের অনুমতি দেওয়া জোর দাবি জানিয়েছেন ফুল চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রমতে, যশোর জেলার আটটি উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়। তার মধ্যে ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারার প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কৃষক ছয় হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করছেন। আর সেই উৎপাদিত ফুল দিয়ে দেশের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ জোগান দেন ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালীর কৃষকেরা। ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও করোনার কারণে ফুলের উৎপাদন ব্যাহত হয়। করোনার মধ্যেই চলতি বছরের বিভিন্ন দিবসকে টার্গেট করে আগস্ট থেকে এই অঞ্চলের ফুলচাষিরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।
ফুলের খেত পরিচর্যায় এখন মহাব্যস্ত তারা। করোনায় ধূসর থাকা জমিতে কয়েক মাস হাড়ভাঙা খাটুনির মাধ্যমে তাদের জমিতে বাহারি রঙের ফুল ফোটাতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে ২৭২ হেক্টর জমিতে গ্লাডিওলাস, ১৬৫ হেক্টর জমিতে রজনীগন্ধা, ১০৫ হেক্টর জমিতে গোলাপ, ৫৫ হেক্টর জমিতে গাঁদা, ২২ হেক্টর জমিতে জারবেরা এবং ৬ হেক্টর জমিতে অন্যান্য ফুলের চাষ হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিবছর বিশ্ব ভালোবাসা, বসন্ত উৎসব ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও; করোনার এই অনিশ্চিত সময়ে তারা এবার কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেনি।
তবে, আসছে বিভিন্ন দিবসে এ অঞ্চলের কৃষকরা যদি তাদের টার্গেট অনুযায়ী ফুল বিক্রি করতে পারেন, তাহলে করোনা ও আম্পানের ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতে পারলেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষকেরা।
গদখালী এলাকার হাঁড়িয়াদাড়া গ্রামের তারেক হোসেন চলতি বছরে দুই বিঘা জমিতে গোলাপ ফুল চাষ করেছেন। ফুল চাষের সঙ্গে গদখালী বাজারে ফুলের দোকানও রয়েছে তার। ফুলের বাজার ও চাষিদের বর্তমান কী অবস্থা জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৩০ বছর ধরে ফুল চাষ করি। সারা বছর তেমন ফুল বিক্রি না হলেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ এই তিন মাস আমাদের ব্যবসার মাস। আর এই তিন মাসের ফুলের বাজার ধরতে বছরের আগস্ট থেকে ফুলের চারা রোপণ করা শুরু করি।
তবে করোনা আর আম্পানের ধাক্কায় ফুলের চারা রোপণ করতে দেরি হয়েছে এবার। চলতি বছরের সামনে যে দিবসগুলো আছে, সেগুলোর বাজার ধরতে আমরা ইতিমধ্যে খেত পরিচর্যা শুরু করেছি। এবার যদি গেল বছরের মতো ফুল পরিচর্যা করার পর ফুল বিক্রি করতে না পারি, তাহলে ঋণের কিস্তিতে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ঝিকরগাছার পানিসারা এলাকার ফুলচাষি আজিজুর সরদার বলেন, করোনার কারণে ৬ থেকে ৭ মাস কোন ফুল বেচাকেনা করতে পারেনি। আম্পানে ভেঙে যাওয়া শেডের টিন বিক্রি করে পাওয়া ৬০ হাজার টাকা দিয়ে সংসার চালিয়েছি। সহায়তা পেয়েছি কয়েক কেজি চাল ও আলু। করোনার আগে পাঁচ বিঘা জমিতে ফুল চাষ করলেও ঋণের কারণে এবার এক বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছি। গেল বছর তো ফুল চাষে যা বিনিয়োগ করেছিলাম, সব জলে গেল। করোনায় এবার কী হবে ভাবছি! দুশ্চিন্তায় আছি।
মনজুরুল ইসলাম নামে আরেক ফুলচাষি বলেন, গদখালী-পানিসারার ফুলচাষিরা সামনের পয়লা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস আর ভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে আমি দুই বিঘা গোলাপ খেতে পরিচর্যা করছি। গেল কদিন ধরে শীতের কুয়াশা পড়ায় গোলাপের কুঁড়িতে পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। সকাল-বিকেল তাই স্প্রে করছি। তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর ধরে ফুলের চাহিদা একটু কম। প্লাস্টিকের ফুল বাজারে আসাতে প্রাকৃতিক ফুল বিক্রি কম হচ্ছে। ফলে চাষিদের কম দামেই ফুল বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে ফুলচাষিরাও ধীরে ধীরে অন্য পেশামুখী হচ্ছেন।
গদখালী গ্রামের আনার আলী নামে আরও এক ফুলচাষি জানান, বর্তমানে গদখালী বাজারে পাইকারি ফুল বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস গোলাপ ফুল ৪-৫ টাকা, জিপসি ফুল বান্ডেল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, গ্লাডিওলাস রংভেদে ১০ থেকে ১৫টা পর্যন্ত, ক্যালেন্ডার এক বান্ডেল ৫০০ টাকা, জারবেরা ফুল ৬ থেকে ১০ টাকা, গাঁদা ১০০ থেকে ১৫০ টাকা প্রতি শ। তিনি আরো বলেন, একটি জারবেরা শেড তৈরি করতে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। কিন্তু ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে জারবেরা শেডে খুব ক্ষতি হয়েছে।
নতুনভাবে এই শেড তৈরি করতে কোনো প্রকার ঋণ পায়নি ফুলচাষিরা। ফলে বিগত বছরের তুলনায় এবার জারবেরা ফুলচাষি কমে গেছেন। ফলে এবারের ফুলের মৌসুমে জারবেরা সরবারহ কমে যাবে এবং দামও পাবেন বেশি। বসন্ত উৎসব আর ভালোবাসা দিবস একই দিন হলে ফুল বিক্রি একটু কম হচ্ছে। আলাদা দিবসে আমাদের ফুলের চাহিদা বেশি থাকে। তবে এই দিবস আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমি ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারব বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম ঢাকা পোস্টকে জানান, এবার ঝিকরগাছায় সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করে কৃষক। গত বছর করোনার কারণে কেউ ব্যবসা করতে পারেননি। গদখালী অঞ্চলে পাঁচ হাজার কৃষকের মধ্যে ৫৫ জন সরকারের প্রণোদনা ঋণ পেয়েছেন। বাকিরা এনজিও ঋণ ও অনেকে জমি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন। করোনাভাইরাস ও সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ফুল সেক্টরের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। সেই অবস্থা থেকে এবারের ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর অন্তত ৫০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে দুই কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতো। প্রতিবছর পয়লা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস আর ভাষা দিবসে ৫০ থেকে ৬০ কোটি ফুল বেচাকেনার লক্ষ্যমাত্রা ধরলেও এবার করোনার কারণে এই টার্গেট বলা বড় মুশকিল।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র জানান, যশোর ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে এবার সাড় ছয় হাজার হেক্টর জমি ফুলের আবাদ করা হয়েছে। কিন্তু মহামারি করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে সব ফুলচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। করোনায় ফুলচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চলতি মাসে তাদের ভালো ফুল বিক্রি হয়েছে। এরই মধ্যে ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত ৩০০ জন চাষির মাঝে বিনামূল্যে ধানের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ৫০০ কৃষকের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছি। যারা প্রকৃত ফুলচাষি, তাদের চিহ্নিত করে আরও সহযোগিতা করার চিন্তাভাবনা আমাদের আছে।
এনএ