হাজারী গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে ২৫ পরিবার

স্বাদে আর গন্ধে অতুলনীয় মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়। শত বছর ধরে জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা, গোপীনাথপুর, বাল্লা এলাকার গাছিরা এই গুড় তৈরি করে আসছেন। কথিত আছে- এই গুড় খেয়ে অভিভূত হয়েছিলেন ব্রিটিশ রানি এলিজাবেথ। মনোমুগ্ধকর এই হাজারী গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন হাজারী পরিবারসহ ২০ থেকে ২৫টি গাছি পরিবার।
প্রতি বছর শীত মৌসুমে খেজুর রস ও গাছ একটি শিল্পে পরিণত হয়। খেজুর রস থেকে বিখ্যাত এই গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন পেশাদার গাছি ও বাড়ির গৃহিণীরা। শীত শুরু হওয়ার পর থেকে পরবর্তী তিন মাস ধরে খেজুর রস থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই হাজারী গুড় তৈরি করেন গাছিরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কাক ডাকা ভোরে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকার হাজারীপাড়ার গাছি জাহিদ হাজারী। তার মতো একাধিক গাছিও রস সংগ্রহ করছেন। সেই রস ভাঁড়ে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরে বাড়ির গৃহিণীরা মাটির চুলার ওপরে রাখা টিনের তাফালে হাঁড়ি থেকে রস ছেঁকে ঢালছেন। এরপর চুলায় আগুন দিয়ে জ্বাল দেন। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত চলে এই হাজারী গুড় তৈরির মহাকর্মযজ্ঞ।

আলাপকালে হাজারী বংশের জাহিদ হাজারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাজারী গুড় তৈরি করার প্রক্রিয়াটা আমি বাবার কাছ থেকে শেখেছি। বাপ-দাদারাও এই গুড় তৈরি করতেন। আমরা সাত পুরুষ ধরে এই হাজারী গুড় বানাচ্ছি। হাজারী গুড় বানানোর মূল কাজটি হলো খেজুর গাছ। এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করতে হয়। আগের মতো গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। আবহাওয়া ভালো থাকলে রস ও গুড় ভালো হয়। দিন দিন খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় গুড় উৎপাদন এখন আগের চেয়ে অনেক কম হয়।
হাজারী গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে তার ছেলেও এ পেশায় সম্পৃক্ত হবেন কিনা জানতে চাইলে জাহিদ হাজারী বলেন, আমি লেখাপড়া করিনি। এ জন্য বাবার মতোই গাছি হয়েছি। কিন্তু আমার ছেলে লেখাপড়া করছে। সে লেখাপড়া করে আমার মতো গাছি হবে কিনা তা বলতে পারছি না। তবে এই গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে কেউ না কেউ তো এই গাছির পেশায় আসবেই।

জাহিদ হাজারীর স্ত্রী রেশমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবাও একজন গাছি ছিলেন। বিয়ের আগ পর্যন্ত নিজেদের বাড়িতে শীতের সময় রস জ্বাল দিতাম। বিয়ের পরে স্বামীর বাড়িতেও এসে দেখি এখানেও খেজুর রস থেকে গুড় বানানো হয়। প্রায় ২২ বছর ধরে হাজারী গুড় বানানোর কাজে স্বামীকে সহযোগিতা করি। এই কাজ করতে খুব ভালো লাগে, এই সিজনে এই কাজ না করলে ভালোও লাগে না। তবে আগের মতো রস না হওয়ায় গুড়ও কম হয়। আগে গাছি রাখতাম, কিন্তু গাছির খরচ বেশি দিতে হয় বলে এখন নিজেরাই গুড় বানাই।
হাজারী বংশের আরেক গাছি শাহেদ হাজারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার আবহাওয়া তেমন ভালো না থাকায় গাছ থেকে রস কম পাচ্ছি। ফলে হাজারী গুড়ের উৎপাদনও অনেক কম হচ্ছে। তবে গুড়ের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় আমরা লোকজনকে গুড় দিতে পারছি না। গতবার প্রতিদিন ৫ থেকে ৮ কেজি গুড় বানানো গেছে, আর এ বছর প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ কেজি গুড় বানাতে পারছি।

হাজারী গুড় তৈরি করে পরিবার নিয়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে ভালোই আছি। ১৪ বছর বয়স থেকে এই গুড় তৈরির কাজ করছি। প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেল এই কাজ করছি। আগে অনেক গুড় উৎপাদন হতো। দিন দিন খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় গুড়ও কমে গেছে। কারণ হাজারী গুড় হয় খেজুর গাছের রস থেকে।
প্রতি বছর কেমন গুড় উৎপাদন হয় এবং আয় রোজগার কেমন হয়- জানতে চাইলে শাহেদ হাজারী বলেন, গতবার আবহাওয়া বেশ ভালো ছিল, যে কারণে প্রায় ৩০০ কেজি গুড় উৎপাদন করা গেছে। প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার মতো গুড় বিক্রি করতে পারছি। এ বছর গুড়ও কম হবে, আয় রোজগারও কম হবে।

শাহেদ হাজারীর স্ত্রী শিরিন বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিন বাড়িওয়ালা (স্বামী) ভোরে যায় রস আনতে, আর আমরা চুলার ছাই ফালাই, টিনের তাফাল পানি দিয়ে ধুই (পরিষ্কার), জ্বাল দেওয়ার জন্য নাড়াসহ গুড় তৈরির কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপ্রত্র প্রস্তুত রাখি। রস আনার পরে তাফালে রস ঢেলে দিয়ে চুলায় জ্বাল (আগুন) ধরিয়ে দেই। কোনো দিন চার হাঁড়ি, আবার কোনো দিন পাঁচ হাঁড়ি রস হয়। তবে আবহাওয়া ভালো থাকলে রস বেশি হয়।
তিনি আরও বলেন, এক হাঁড়ির রস তাফালে জ্বাল দেই। প্রায় ৩০ মিনিটি জ্বাল দেওয়ার পরে রস গুড় তৈরির উপযুক্ত হয়। পরে তাফাল থেকে কুলায় সেটা ঢালি। আবার আরও এক হাঁড়ির রস জ্বাল দেই। এবাবে দুই হাঁড়ি রসে এক সাঁঝ হয়। তাতে ১০ পাটা বা আড়াই কেজি হাজারী গুড় হয়।
এই পেশায় কতদিন আর অনুভুতি কেমন জানতে চাইলে শিরিন বেগম বলেন, বিয়ের প্রায় ২৫ বছর হয়েছে। বিয়ের পর আমার শাশুড়িকে দেখেছি এই কাজ করতে, তার কাছ থেকে শিখে, স্বামীর সংসারে এই ২৫ বছর ধরেই হাজারী গুড় তৈরির কাজ করছি। প্রতিদিন অনেক দূর-দূরান্ত থেকে অনেক লোকজন আসে এই গুড় বানানো দেখতে। আমাগো খুব ভালোও লাগে। হাজারী গুড় বানাইতে অনেক কষ্টও আছে। তবে গুড় বিক্রির পর যখন টাকাগুলো হাতে পাই, তখন আর এই কষ্টকে কষ্ট মনে হয় না।
রাজধানী ঢাকার আদাবর থেকে বিখ্যাত হাজারী গুড় কিনতে আসা নাছের হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিখ্যাত এই হাজারী গুড় সম্পর্কে আগে শুনেছি, এটির ঐতিহ্য আর সুনামও রয়েছে। এখন মিডিয়ার কারণে আরও ভালো করে এই গুড় সম্পর্কে জানতে পারছি। এখানে আসার পর হাজারী গুড় তৈরির মূল কাজটি নিজ চোখে দেখলাম, গুড় খেলাম। এই গুড়ের মূল ঘ্রাণ ও স্বাদ খুব সুন্দর এবং অতুলনীয়। এখান থেকে গুড় কেনা সহজ নয়। কারণ এই গুড়ের অনেক চাহিদা রয়েছে। তারপরও তারা আমাদের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
হাজারী বংশের রহিজ হাজারী ঢাকা পোস্টেকে বলেন, হাজারী প্রামাণিক থেকে আমি সপ্তম পুরুষ এই হাজারী গুড় তৈরি করে আসছি। বাপ-দাদার কাছ থেকে এই গুড়ের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কথা শুনেছি। ব্রিটিশ রানি এলিজাবেথও নাকি এই গুড় খেয়ে অভিভূত হয়েছিলেন। দেশ-বিদেশেও এই গুড়ের সুনাম রয়েছে।

বিখ্যাত এই গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাজারী গুড় তৈরি হয় খেজুর রস থেকে। আগে এই এলাকায় অনেক খেজুর গাছ ছিল, তবে দিন দিন এই গাছ কমে যাচ্ছে। কাজেই হাজারী গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে বা বেসরকারি অথবা ব্যক্তিগতভাবে এই খেজুর গাছ রোপণ করতে হবে। এছাড়া অসাধু গুড় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
রহিজ হাজারী আরও বলেন, ঝিটকা বাজারসহ মানিকগঞ্জের বাজারে খেজুর গুড়ের বিশাল পসরা বসলেও হাজারী গুড় সেখানে অনন্য। এজন্য এই গুড়ের দাম প্রচলিত পাটালির তুলনায় অনেক বেশি। বর্তমানে এক কেজি হাজারী গুড় বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। শত বছর ধরে দেশজুড়ে সমানভাবে এই হাজারী গুড়ের সুনাম রয়েছে। এমনকি সরকারিভাবে এই গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং সুনামকে স্বীকৃতি দিতে ‘লোক সংগীত আর হাজারী গুড় মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর’ নামে জেলা ব্রান্ডিং করা হয়েছে। নামকরণ করা হয়েছে ‘ঝিটকা হাজারী গুড়’। এই অঞ্চলে এক সময় শতাধিক পরিবার হাজারী গুড়ের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতো। বতর্মানে ২০ থেকে ২৫টি গাছি পরিবার এই গুড় তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এ বছর হাজারী গুড় উৎপাদন কম হচ্ছে বলে জানান তিনি।
হাজারী গুড় তৈরির প্রক্রিয়া
এই গুড়ের মূল উৎস খেজুর গাছের রস। গাছিরা গাছ থেকে রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে গুড় তৈরির মধ্যে রয়েছে আদি এক বিশেষ প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও হাজারী গুড় তৈরি এই প্রক্রিয়ার কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানান গাছিরা। বেশি শীত অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এই গুড় উৎপাদনের উপযুক্ত সময়। আগের দিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশেষ কায়দায় গাছ কেটে হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে সেই গাছগুলো থেকে রস সংগ্রহ করে ময়লা পরিষ্কার করে মাটির চুলার ওপর বসানো টিনের তাফালে ছেঁকে রস ঢালা হয়। এরপর মাটির চুলায় জ্বাল ধরিয়ে পরিমাপ মতো নাড়া দিয়ে জল দিয়ে রস ঘন করতে হয়। তারপর রসের ঘনত্ব বেড়ে গেলে বা আঁশ আসলে একটি মাটির কুলায় (হাঁড়ি) বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৩০ মিনিট ঘুঁটে তৈরি করা হয়। সাদা রঙের এই হাজারী গুড়।
আরএআর