তোমার মায়ের যে আর কেউ রইল না

২০১৩ সালের ১৭ অক্টোবর বগুড়ার শেরপুর থেকে মোটরসাইকেলে করে নাটোরে আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন হিমেলের বাবা–মা। তার মা প্রাণে রক্ষা পেলেও মানসিক ভারসাম্যহীনে পরিণত হন। এখনো তার চিকিৎসা চলছে। দুর্ঘটনা–পরবর্তী জটিলতা ও কিডনি রোগে তার বাবারও মৃত্যু হয় ২০১৭ সালে।
তৃতীয় শোকসংবাদটি আসে ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। আহসান হাবীবের মৃত্যুর পর তার মা আমেনা বেওয়াও শেরপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যান।
সব হারিয়ে মুনিরা আক্তার তখন একমাত্র সন্তান মাহমুদ হাবিব হিমেলকে নিয়ে নাটোরে তার বাবার কাছে চলে আসেন। হিমেল পড়ালেখার জন্য রাজশাহীতে থাকতেন। মাকে দেখতে মাঝেমধ্যে তিনি নাটোরে আসতেন। মায়ের ইচ্ছা ছিল, পড়ালেখা শেষে ছেলে চাকরি করবে। সবাই একসঙ্গে থাকবে। কিন্তু সেই স্বপ্নও চিরদিনের মতো স্বপ্নই থেকে গেল।
গত মঙ্গলবার রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেল। বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টার কিছু পর নাটোর শহরের শুকলপট্টি মহল্লার নানাবাড়িতে তার মরদেহ আনা হয়। এ সময় ছেলের কফিনবন্দী মরদেহের পাশে নির্বাক মা মুনিরা আক্তার নিশ্চুপ বসে আসেন। মাঝেমধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তা শব্দ হয়ে কারও কানে পৌঁছাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, মা-ছেলে কথা বলছেন। পাশে খালা, নানি, সহপাঠীরাসহ অন্য স্বজনদের চোখে অঝোরে ঝরছে অশ্রু।

এ সময় মা ও বৃদ্ধ নানা-নানির আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। স্কুল–কলেজের সহপাঠী ও প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন মাহমুদকে একনজর দেখার জন্য। কিন্তু ভিড় ঠেলে কফিনের কাছে এসে প্রিয় মাহমুদের মুখখানা দেখতে না পেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন সবাই। ফুলে ঢাকা কফিনের কোথাও মাহমুদের শরীরের এতটুকু দেখা যায়নি। দুর্ঘটনায় তার মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় মৃতদেহটি বাক্সবন্দী করে ফেলা হয়।
কিছুক্ষণ পর নানা মনিরুজ্জামান চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, নানা ভাই, তোমাকে ছাড়া আমি এ পৃথিবিতে নিশ্বাস নেব কী করে? তোমার মায়ের যে আর কেউ রইল না। ওকে আমি কী বলে সান্ত্বনা দেব?
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে স্থানীয় একটি স্কুলের মাঠে নেওয়া হয়। কফিন রাখার জন্য ছোট্ট একটা শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। সেখানে মাহমুদকে দেখতে এসেছেন বহু মানুষ। জেলার পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহাসহ পুলিশের শতাধিক সদস্যও ছিলেন সেখানে। মাহমুদের কফিনটি আগলে রাখলেন মা মুনিরা আক্তার, নানা মনিরুজ্জামান, খালু সবুর হোসেনসহ শতাধিক সহপাঠী।

এরপরই খালু সবুর হোসেন সহপাঠীদের কাছে তাদের প্রিয় বন্ধুর মৃতদেহ জানাজার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলেন। বন্ধুমহলে আবারও কান্নার রোল পড়ে গেল। বন্ধু-স্বজনেরা কফিন কাঁধে রওনা হলেন বাসস্ট্যান্ড মসজিদের মাঠে। সেখানে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে মাহমুদের মরদেহে শ্রদ্ধা জানানো হয়। জানাজার নামাজ পড়ান মাহমুদের খালাতো ভাই।
ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছুঁইছুঁই। তখন মাকে রেখে হিমেল ছুটলেন না-ফেরার দেশে। নানাবাড়ির অদূরে গাড়িখানা কবরস্থানে দাফন করা হয় মাহমুদ হাবিব হিমেলকে।
এলাকাবাসী মো. জাহিদুল হুদা ফরহাদ বলেন, অত্যন্ত মেধাবী ছিল হিমেল। তার অকালমৃত্যু আমাদের নির্বাক করেছে। একের পর এক দুর্ঘটনা তার পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে।
২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহিদুর রহমান জাহিদ বলেন, মাহমুদ হাবিব হিমেল এভাবে চলে যাবে, ভাবতে পারিনি। তার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। পরিবারের তিনজনকে হারিরে হিমেলের মা নির্বাক। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
এনএ