নাচকে সমৃদ্ধ করে মানুষের কাছে তুলে ধরতে চান ইরা

মোবাশ্বিরা কামাল ইরা। জন্ম উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁয়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে তার ব্যালে নৃত্যকলার কয়েকটি ছবি মুগ্ধতায় ডুবিয়েছে নেটিজনদের। ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এতে প্রশংসায় ভাসছেন এই তরুণী। তার ওই ছবিগুলো যখন চারদিকে আলো ছড়াচ্ছে, তখন ইরা নওগাঁর বাড়িতে বসেই মিডিয়া সামলাচ্ছেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসছে ইরার জীবনের গল্প। জিম, স্কেটিং, টেনিস ও ক্রিকেটে সমান পারদর্শী ইরা মূলত ব্যালে নাচের জন্যই নেট দুনিয়ায় পরিচিতি পাচ্ছেন। তিনি নাচের সুবাদে গিয়েছেন তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে। সব জায়গায় সুনাম কুড়িয়েছেন।
মোবাশ্বিরা কামাল ইরা নওগাঁ শহরের জগৎসিংহপুর মহল্লার আবু হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল ও ফাহমিদা আক্তার দম্পত্তি চার মেয়ের মধ্যে তৃতীয়। তার বাবা একজন স্থানীয় ফার্নিচার ব্যবসায়ী ও মা গৃহিণী। নওগাঁ সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষে বাণিজ্য শাখায় পড়ছেন তিনি। ২০২০ সালে নওগাঁ সীমান্ত পাবলিক স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। দেশের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁ থেকে পড়ালেখা ও অনুশীলন করে সাফল্য এনেছেন অনেক।
বরাবরই নাচ করতে ভালোবাসেন ইরা। শৈশবে নাচের শিক্ষক সুলতান মাহমুদের কাছে নাচ শিখেছেন। পরে ঢাকায় ভরতনাট্যম নাচ শেখেন। সাশ্রয়ী নৃত্য ও ভরতনাট্য নিয়ে ভারতে গিয়ে কিছু শেখার ইচ্ছা ছিল তার। তবে ব্যালে নাচের ভাবনা মনে ঠাঁই নেয় ২০২০ সালে লকডাউনের সময়। ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিখতে শুরু করেন ব্যালে। ব্যালে-জিমন্যাস্টিক মিলিয়ে পারফর্ম করেন তিনি। এরপর ২০২১ থেকে সাধনা সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেন ইরা।
মোবাশ্বিরা কামাল ইরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, লকডাউনের সময়ে ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে আপলোড করতাম। সেখান থেকে সাগর দেবনাথ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার ইচ্ছা ছিল এ ধরনের (ব্যালে) ফটোশুট নিয়ে কাজ করার। আমিও সমর্থন দিলাম। তারপর ঢাকায় যমুনা ফিউচার পার্কে কিছু ফটোশুট করলাম। এরপর জয়িতা আফরিন আপু ছবিগুলো দেখেন এবং তিনিও এ ধরনের ছবি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। গত বছরের ২ নভেম্বর ধানমন্ডির লেকের পাড়ে ফটোশুট করা হয়। সেই ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোডের পর মোটামুটি ভালো একটা সাড়া পাওয়া যায়।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ছবিগুলো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা যেহেতু স্বাধীন দেশের নাগরিক, সেহেতু স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল আমার। আমার কাছে রাজু ভাস্কর্য স্বাধীনতা এবং মুক্তির প্রতীক মনে হয়েছিল। সেই চেতনা থেকেই সেখানে ফটোশুট করা। ছবিগুলো ভাইরাল হবে এমন চিন্তা মাথায় ছিল না। ২৩ জানুয়ারি ফটোশুট করা হলেও ২৫ জানুয়ারি আপলোড করা হয়। ফটোশুটের আগে এবং পরে ভয়ে ছিলাম। ছবি ফেসবুকে আপলোড করার ২ ঘণ্টা পরও দুশ্চিন্তায় ছিলাম, আগের মতো সাড়া পাব কিনা। এরপর বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন পেজে শেয়ার হতে থাকে। আমার ম্যাসেনজারে বিভিন্ন মিডিয়া সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করে। সবাই আমাকে সমর্থন জুগিয়েছে। এটা আমার কাছে বড় একটা প্রাপ্তি। যা আমাকে সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা দেবে।
এই হাওয়ায় ভাসার ফর্মটা কী ধরনের শিল্প জানতে চাইলে ইরা বলেন, ব্যালে ও জিমন্যাস্টিক মিলিয়ে একটা ফর্ম। পুরোপুরি ব্যালেও বলা যাবে না। দুটোর সমন্বয়ে একটা নতুন কিছু।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে নাচ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে চাই। যেন নাচের মাধ্যমে কথা বুঝাতে পারি। কথা দিয়ে নাচ নয়। নাচকে সমৃদ্ধ করে মানুষের কাছে তুলে ধরতে চাই। আমাদের নাচের সংস্কৃতিকে বাহিরের দেশে এবং বাহিরের নাচের সংস্কৃতিকে দেশে পরিচিত করতে চাই। এ দুইয়ের সংমিশ্রনে নতুন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মোবাশ্বিরা কামাল ইরার পাখির মতো শূন্যে উড়ার মুহূর্তগুলোকে ফ্রেমবন্দি করেন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার জয়িতা আফরিন। তিনি ঢাকার ধানমন্ডিতে থাকেন।
জয়িতা আফরিন বলেন, আমি তো ফটোগ্রাফার। আমার কাজ ছবি উঠানো আর পোস্ট করা। আমার একটা নিজের প্রজেক্ট ছিল। সেখানে একটা কাজের জন্য ব্যালে মুভ দরকার ছিল। এই জন্য ইরাকে বলছিলাম আমার একট ছবি প্রজেক্টে থাকতে। ছবি তুলেছি, পোস্ট করেছি। ছবিগুলো মানুষের গ্রহণ যোগ্যতাা পেয়েছে। প্রশংসা নিতে কার না ভালো লাগে।
ইরার মা ফাহমিদা আক্তার বলেন, ২০১৭ সালে নাচে হাতেখড়ি ইরার। এরপর একটার পর একটা সাফল্য আসতে থাকে। কোথাও তাকে থেমে থাকতে হয়নি। তার প্রতিভা দেখে আমারও আগ্রহ বাড়তে থাকে। যদি একটু সহযোগিতা করা যায়, মেয়ে হয়তো আরও ভালো করতে পারবে।
তিনি বলেন, মেয়ের এই শখের নাচের বিশেষ ধরনের জুতা এখনো কিনে দিতে পারিনি। বাংলাদেশে সচরাচর এই জুতা পাওয়া যায় না। তাই খালি পায়ে অনেক কষ্টে ব্যালে নাচ করতে হয়।
ইরার বাবা আবু হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল বলেন, প্রথমত মেয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষিত হবে এবং চাকরি করবে এটাই চাই। দ্বিতীয়ত এ নাচকে সে সারাবিশ্বে পরিচিত করাসহ দেশের সুনাম বয়ে নিয়ে আসবে। মেয়ে যতটুকু সামনে এগিয়ে যেতে পেরেছে সবটুকু চেষ্টা তার মায়ের। মেয়ের জন্য সে অনেক চেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকার করেছে।
নৃত্য রং একাডেমি নওগাঁর প্রশিক্ষক সুলতান মাহমুদ বলেন, মোবাশ্বিরা কামাল ইরা ছোট থেকেই আমার কাছে নাচ শিখেছে। হাতে গোনা যে কয়জন প্রথম সারির শিক্ষার্থী রয়েছে সে তাদের মধ্যে একজন। সে খ্যাতি অর্জন করে দেশ-বিদেশে নওগাঁবাসীর মুখ উজ্জ্বল করবে এটাই আমার চাওয়া।
নওগাঁ সীমান্ত পাবলিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোলাম রসূল সাকলাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইরা আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থী। মেয়েটা অনেক ক্রিয়েটিভ। তার অনেক প্রতিভা। বাবা-মাসহ ইরার অনেক আগ্রহ ছিল নাচ নিয়ে। আমরা সেই পরিবেশ দিতে পেরেছি, সে ভালো কিছু করতে পেরেছে। আগামীতে দেশের হয়ে ইরা সারাবিশ্বে আরও ভালো কিছু করে দেখাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
দেলোয়ার হোসেন/আরএআর