রুপালি বালুচরে সবুজের বিপ্লব

কয়েক মাস আগেও বন্যার পানিতে টইটম্বুর ছিল তিস্তার বুক। তখন পানির তোড়ে নদীতে বিলীন হয়েছে ঘরবাড়িসহ ফসলি জমি। কান্নায় ভারী হয়েছিল নদীপারের অসহায় মানুষের আহাজারি। কিন্তু তিন মাসের ব্যবধানে সেই তিস্তা এখন পানিশূন্য। বিদায় নিয়েছে বন্যা, বিদায় নিয়েছে পানি। জেগে উঠেছে তিস্তার বুকজুড়ে শুকনা বালুচর।
পানিশূন্য তিস্তায় এখন নৌকা নেই। নেই জেলের মাছ ধরা নিয়ে ছোটাছুটি। এখন জেগে ওঠা ধু-ধু বালু চর কৃষকের দখলে। চলছে ফসল আবাদের মহাউৎসব। যেন বিস্তীর্ণ নদীর বুকে সবুজের বিপ্লব।
বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল থেকে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত ধামুর বাঁধেরপাড়, গান্নারপাড়, বোল্লারপাড়, বুড়িডাংগি, চর ইচলিসহ বেশ কিছু এলাকাসহ বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা গেছে, নদীর এপার-ওপার বিস্তৃণ সবুজে ভরা। যেন দিগন্তজুড়ে সবুজে মাখামাখি। রুপালি বালুচর ছেয়ে গেছে সবুজ পাতায়।
তিস্তার রুদ্ররূপ ভুলে যাওয়া চরের বাসিন্দারা এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ফসল ফলানোর কাজে। খেতে সার দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা, পানি দেওয়া, ফসলের যত্ন নেওয়াসহ নানা কাজে সময় পার করছেন চরের কৃষকেরা। দম ফেলানোর ফুসরত নেই কারও। সবার চোখেমুখে আগামীর স্বপ্ন বুননের ব্যস্ততা। রাশি রাশি বালুর বুকে কোদাল আর লাঙ্গঙলের ফলা চালিয়ে বীজ বপনে চাষ করছেন রবি মৌসুমের ১৮ ধরনের ফসল।
ফুটন্ত চরে পানি ঢেলে বালুকে শক্ত করে কৃষকেরা বুনছেন আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মিষ্টিকুমড়া, ভুট্টা, তামাকসহ নানা ধরনের শাকসবজি। শুকনা মৌসুমে গেল বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভালো ফসল ফলানোর সুযোগ নষ্ট করতে চান না তারা। গঙ্গাচড়া শেখ হাসিনা তিস্তা সড়ক সেতুর নিচে কথা হয় গান্নারপাড়ের কৃষক মাসুদুর রহমানের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে এই কৃষক বলেন, বন্যার পানি নামি গেইছে। এ্যলা চর জাগছে। এই চরের হামরা কুমড়া, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শষা আবাদ করি। এত কষ্ট করি আবাদ করিয়া কোনো বছরে দাম পাই। ফির কোনো বছরেও দামে পাই না। দাম পাইলে তো গেরোস্তোর লাভ হয়, না পাইলে ক্ষতি। এই লোকসানটা আর পূরণ করা যায় না।
একই এলাকার জাহেদুল ব্যস্ত স্যালো মেশিনে তোলা পানি খেতে ছিটানো নিয়ে। অনেক ব্যস্ততার ফাঁকে একটুখানি কথা হয় তার সঙ্গে। জাহিদুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদী একেবারে শুকি গেইচে। এ্যলা চাষ করার চরোত পানি নাই। কষ্ট করি, বোরিং করি পানি নেওয়া লাগে। অথচ বন্যার সময় পানি পাই। আবাদের সময় পানি পাই না। আবাদের সময় যে পানি কোথায় যায়, এক আল্লাহ মাবুদ জানে। আমাদের এই কষ্ট কেউ বোঝে না। অনেক সময় শুনি নদী খনন হবে, পানি সোগ সময় পাব। এই আশাতে থাকি, কিন্তু কিছুই তো হয় না। তারপরও আমরা বাঁচি থাকার জন্য আবাদ করতেছি। এই ফসল ফলানোই আমাদের কর্ম। যত ভালো আবাদ হইবে। সামনোত ততই ভালো থাকা যাইবে।
এত কষ্ট করি আবাদ করা হয় দুইটা পয়সার আশায়। এখন খেত তো ভালো দেকা যায়। আশা করতেছি ভালোয় ফসল পাওয়া যাইবে, বলেন তিনি।
কৃষকেরা বলছেন, বালুচর এখন তাদের জন্য আশীর্বাদ। এই চরের বালু মাটিতেই ফলবে সোনার ফসল। ঘুরে যাবে করোনা আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভাগ্যের চাকা। সবজিখেত পরিচর্যায় ব্যস্ত জরিনা বেগম বলেন, চরের মধ্যে আলু, কুমড়া, ভুট্টা লাগাছি। আলু তোলার পর বাদাম লাগামো। পানি না থাকাতে কষ্ট আছে। কিন্তু বালাতে কোনো রকমে চাষবাদ শুরু করা লাগে। তা ছাড়া হামার মতো গরিবেব আর কোনো উপায় নাই।
চর ইচলীর কৃষক মজিদ মিয়া বলেন, ভালো বীজ পাওয়া যায় না। এ্যলা বীজের সমস্যা। তারপরও মিষ্টিকুমড়া লাগাইছি দুই একর মাটিত। বর্তমানে সারের একটু বাড়ছে। বস্তাতে এক শ, দেড় শ টাকা বেশি লাগে। সরকার যদি এটা নিয়ন্ত্রণে আনে। তাহলে হামারগুল্যার আবাদ সুবাদ করতে সুবিধা হইবে। চরের বুকোত এ্যলা যত আবাদ দেখোছেন, সোগে অভাবী মানুষেরা করছে। এই আবাদের ফসল ব্যাচে হামাক সংসার চলা লাগবে।
চরে শীতকালেই বেশি ব্যস্ত থাকেন কৃষক। বেশির ভাগ মানুষের কাজই থাকে ফসলের মাঠে। এ মৌসুম থেকে শুরু হওয়া চাষবাদ চলে বর্ষা পর্যন্ত। বর্ষার সময় বন্যার পানিতে এখানকার বেশির ভাগ জায়গা তলিয়ে যায়। ফলে জমিতে পলি পড়ে প্রতিবছরই। এ কারণে ফসল ভালো হয়। পরিচর্যা করলে নানা ধরনের ফসল ফলানো সম্ভব।
শরিফুল ইসলাম, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা
সদর ইউনিয়নের গান্নারপাড় এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, এ বছর দুই একর জমিতে আলুর বীজ বুনেছেন। কেবল পাতা গজাচ্ছে খেতে। আর দেড় মাস পর ঘরে একদম পরিপক্ব আলু তোলা সম্ভব হবে। এতে তার খরচ হবে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। ফলন ভালো ও বাজারে দাম ভালো হলে লাভ হবে বলে আশাবাদী তিনি। একই এলাকার কৃষক বাবলু মিয়া ৯০ শতক জমিতে রসুন লাগিয়েছেন। তিনি জানান, রসুন ওঠানোর পরে একই জমিতে ভুট্টা নয়তো বাদাম চাষ করবেন। এ ছাড়া ইরি ধানের চাষও করার প্রস্তুতি রয়েছে তার।
সরেজমিন গঙ্গাচড়া উপজেলার ধামুর বাঁধেরপাড়, গান্নারপাড়, বোল্লারপাড়, বুড়িডাংগি, শিঙ্গীমারী, মিয়াজী পাড়া, চিলাখাল চর, চর মটুকপুর, খলাইর চর, বিনবিনা, সাউদপাড়া, আলে কিশামত ও উত্তর কোলকোন্দ বাঁধেরধার, বাগডোহরা, মিনার বাজার এলাকাসহ বিভিন্ন চরে দেখা যায়, বেশির ভাগ চাষি আলু, মিষ্টিকুমড়া, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, সরিষা, কলাই, ধনিয়া, শশা, লালশাকসহ বিভিন্ন শাকসবজির চাষ শুরু করেছেন। এসব চরের কৃষকেরা প্রয়োজনীয় সার সরবরাহ, উন্নত মানের বীজ প্রাপ্তিতে সহযোগিতাসহ সেচসুবিধা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন।
গঙ্গাচড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চরে শীতকালেই বেশি ব্যস্ত থাকেন কৃষক। বেশির ভাগ মানুষের কাজই থাকে ফসলের মাঠে। এ মৌসুম থেকে শুরু হওয়া চাষবাদ চলে বর্ষা পর্যন্ত। বর্ষার সময় বন্যার পানিতে এখানকার বেশির ভাগ জায়গা তলিয়ে যায়। ফলে জমিতে পলি পড়ে প্রতিবছরই। এ কারণে ফসল ভালো হয়। পরিচর্যা করলে নানা ধরনের ফসল ফলানো সম্ভব।
এদিকে তিস্তাবেষ্টিত গঙ্গাচড়া ছাড়াও কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার চরগুলোতে চলছে সবুজের আবাদ। তিন উপজেলায় চরের আয়তন ৯ হাজার ৮৫০ হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় আট হাজার হেক্টর চরের জমিকে চাষের আওতায় আনা হয়েছে। চলতি রবি মৌসুমে এসব বালুচরে ভুট্টা, গম, পেঁয়াজ, রসুন, শাকসবজি, আলু, তামাক, মিষ্টিকুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ শুরু হয়েছে বলে জানান রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. সরওয়ারুল হক।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ধু-ধু বালুচরকে আমরা সোনার মাটিতে পরিণত করতে পেরেছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন কৃষকদের জন্য সেচ কার্যক্রম নামে একটি প্রকল্প নিয়েছে। আমরা কৃষকদের যদি প্যাকেজ আকারে তা সরবরাহ করতে পারি, তাহলে চর এলাকার কৃষকদের ভাগ্যের অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটবে।
কৃষি বিভাগ বলছে, রংপুর অঞ্চলের গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে নীলফামারীর ডিমলার ছাতনাই পর্যন্ত নদীর দৈর্ঘ্য ১২৩ কিলোমিটার। যার বুকজুড়ে জেগেছে ৬১৭টি চর। পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ করা গেলে জাতীয় খাদ্যভান্ডারে যুক্ত হবে চরে ফলানো ফসল।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, যদি সেচ-সমস্যার সমাধান এবং পরিবহন-সংকট মোকাবিলা করা যায়, তাহলে কৃষকেরা ভালো দাম পাবেন। নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হবে। কৃষকের চাষাবাদে চাহিদাও বাড়বে। তখন নদীপারের মানুষ চরকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবে। এতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
তিস্তায় যে সাড়ে ৯০ হাজার হেক্টর জমি চাষযোগ্য জমিতে পরিণত হয়েছে, সেখান থেকে ফসলের গড় মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। তবে উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদীকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সারা বছরেই যথেষ্ট পরিমাণ ফসলের জোগান আসবে বলে মনে করছেন তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ নেতা মোহাম্মদ আলী।
তিনি বলেন, যদি তিস্তা নদীকে সত্যিকার অর্থে খনন করা হয়, তাহলে নদীতে জেগে ওঠা চরকে ঘিরে সম্ভাবনা তৈরি হবে। কৃষক অল্প ব্যয়ে অধিক ফসল ফলাতে পারবেন। সঙ্গে চাষাবাদের প্রতি নদীপাড়ের মানুষের ঝোঁক আরও বাড়বে।
এনএ