প্রয়োজন ছাড়া খাল খনন, জমি হারিয়ে কাঁদছেন কৃষক

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী তাড়ানি এলাকায় বিনা নোটিশে ও ক্ষতিপূরণ ছাড়াই কৃষিজমির ফসল নষ্ট করে খাল খনন করা হচ্ছে। এতে ওই এলাকার শত শত বিঘা আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। হতদরিদ্র ১৭টি আদিবাসী গারো পরিবারসহ শতাধিক পরিবার উচ্ছেদ হচ্ছে রেকর্ডীয় সম্পত্তি থেকে।
ভুক্তভোগী এসব পরিবার স্থানীয় চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত মিলছে না কোনো সমাধান। ফলে সব কৃষক পরিবারে এখন গলার কাঁটা হয়ে পড়েছে এই খাল।
জানা যায়, উপজেলার কালাকুমা বৈশাখী বাজার থেকে তাড়ানি গ্রামের ভোগাই নদী পর্যন্ত ৬ থেকে ৭ ফুট গভীর এবং ১৫ থেকে ১৬ ফুট প্রশস্ত করে প্রায় ৩ কিলোমিটার খাল খনন করা হচ্ছে। মোট ৮ কিলোমিটার খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তাড়ানি এলাকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে নাগরিক সমাজের স্থানীয় (জেলার) ১৫ সদস্যর প্রতিনিধিদল।
জমি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জোবেদা বেগম বলেন, আমি কত চেয়ারম্যানের কাছে দৌড়াদৌড়ি করেছি। তাকে অনুরোধ করেছি। ভাই আমার মাত্র পাঁচ কাঠা জমি। আমার স্বামী নাই, বিধবা। আমার পরিবারে দুই মেয়ে আছে। যাদের বিয়ের বয়স হয়েছে। এই জমির ধান দিয়ে সারা বছর আমাদের চাহিদা মেটে। যখন আমার জমিতে ভেকু (মাটি খননযন্ত্র) দিয়ে খাল খনন শুরু করল। তখন আমি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দুইজনের পায়ে ধরেছি। কান্নাকাটি করেছি। কেউ আমার কথা শুনে নাই, মানে নাই।

ভুক্তভোগী নেকজান বেগম বলেন, আমার স্বামী-সংসার কিছু নাই। দীর্ঘদিন ঢাকার বাসা-বাড়িতে কাম কইরা কিছু টাকা জমায় ছিলাম। সে টাকা দিয়ে কিছু জমি কিনেছিলাম। এই জমিতে ফসল ফলাইতাম। ফসল বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চালাইতাম। এখন আমার পুরা জমিতে খাল খনন করা হয়েছে। কত মানুষের পায়ে ধরলাম। কেউ আমার কথা শুনল না। আমার কেনা জমিতে তারা খাল খনন করল। অথচ আমারে কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ দিল না।
জমিলা খাতুন বলেন, আমার মাত্র সাত কাঠা জমি। তার মধ্যে চার কাঠা জায়গার মধ্যে খাল খনন করা হয়েছে। সম্পূর্ণ জমি আমার ক্রয় করা সম্পত্তি। খাল খননের বিষয়ে আমাকে কেউ কোনো নোটিশ দেয় নাই। জোর করে তারা আমার জমিতে খাল খনন করল। এখন সরকারের কাছে আমার দাবি। তারা আমার জমি নিয়েছে, এটির বিষয়ে আমার কোনো কথা নাই। আমাকে যেন যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
আদিবাসী পরিবারের সেংরিম মানকিন বলেন, এমনিতে আমরা আদিবাসী গারো সম্প্রদায়। আমাদের জমিজমা কম। এদিকে সব খাল খননে পড়ে গেছে। এখন পরিবারের সকলকে না খেয়ে মরতে হবে। এ বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
জোবেদা, নেকজান বেগম, জমিলা খাতুনসহ অনেকেই কৃষিকাজে জড়িত। তাদের সবার ভাষ্য, তাদের কোনো খালের প্রয়োজন ছিল না। তারা অন্যভাবে সেচব্যবস্থার মাধ্যমে চাষাবাদ করেন। কিন্তু প্রভাবশালী একটি মহল জোর করে এই খাল খনন করছে বলে তাদের অভিযোগ।
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের কৃষকেরা জনিয়েছিলেন তাদের সেচের জন্য পানি প্রয়োজন। তাই যেন অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি খাল খনন করা হয়। এই খাল খনন বর্তমান সরকারের স্থানীয় নেতারা দেখভাল করছেন। আমরা এ পর্যন্ত তিন-চার কিলোমিটার খাল খনন করেছি। কেউ কোনো প্রকার বাধা প্রদান করেননি।
তিনি আরও বলেন, আমরা তো কারও জমি জোর করে নেই নাই। একটু সমস্যা রয়েছে। এখানে কয়েকটি পরিবারের দাবি মেটাতে গেল খাল খননে অন্য যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদেরও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু তারা সবাই তো ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষতিপূরণ কি পাবেন না, এমন প্রশ্নে তিনি কোনো সদুত্তর দেননি।
নারীনেত্রী আইরিন পারভীন বলেন, আমরা খাল খনন এলাকা পরিদর্শন করেছি। এখানে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। সবাই হাহাকার করছে, কান্নাকাটি করছে। এখানে এমনও পরিবার আছে যাদের পরিবারে কোনো পুরুষ অভিভাবক নেই। মায়েরা কষ্ট করে মানুষের বাড়িতে কাজ করে জমিটুকু কিনেছিলেন। এ ছাড়া যেখানে খাল খনন করা হয়েছে। তার ওই পাশে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তাই বর্ষা মৌসুমে এখানে পড়ে শিশুর মৃত্যুঝুঁকি আছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের কাছে আমরা দাবি জানাই, যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগ শেরপুর জেলা কমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। পরিদর্শনকালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সুবিধা,-অসুবিধার কথা শুনেছি। যেখানে কোনো প্রকার অনুমোদিত নকশা, বাজেট ও পরিকল্পনা ছাড়াই টিআর-কাবিখার টাকায় স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল এ কাজ করছে। তারা তাদের মনগড়াভাবে এ খাল খনন করছে।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় অদিবাসীদের রেকর্ডীয় সম্পত্তির ওপর দিয়ে এ খাল খনন করা হলেও তাদের কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। এই খাল খননে অদিবাসীসহ স্থানীয় নিম্ন আয়ের অনেক পরিবার রয়েছে। যাদের এখানকার ফসল বিক্রির টাকায় সংসারের খরচ চলে। এ ঘটনায় এই এলাকার অন্তত ১৩টি আদিবাসী গারো পরিবারসহ নিম্ন আয়ের শতাধিক পরিবার ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাই ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জোরপূর্বক খাল খননের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের দাবি জানাই।
নালিতাবাড়ী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আব্দুল হান্নানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি অফিসের বাইরে। অফিসে থাকলে হয়তো খাল খননের বিষয়ে সঠিক তথ্যটা আপনাকে জানাতে পারতাম। আমি আপনাকে আধঘণ্টা পর তথ্যটি জানাচ্ছি। এরপর ৩০ মিনিট পর তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যবহৃত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এ বিষয়ে অবগত ছিলাম না। খাল খননের পর কয়েকজন লিখিত অভিযোগ করার পর বিষয়টি জেনেছি। ইতোমধ্যে একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট হাতে এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জাহিদুল খান সৌরভ/এনএ