হঠাৎ জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দ্বিগুণ

• প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ ৯ ব্যাংক, ঘাটতি ২২ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা
• শীর্ষ রয়েছে জনতা ব্যাংক, ঘাটতি ১০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা
বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে খাতা-কলমে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে। কিন্তু আমানতকারীদের জমানো টাকার নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় অর্থ সংরক্ষণ করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি (নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ) দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকায়। যা পুরো ব্যাংক খাতের হিসাব করলে ঘাটতির প্রায় ৭৫ শতাংশই জনতার ঘরে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জানা গেছে, করোনা মহামারিতে ২০২০ সালে গ্রাহক ঋণের কোনো টাকা পরিশোধ না করেও খেলাপি হয়নি। গেল বছরও (২০২১ সাল) ঋণ পরিশোধে ছিল বিশেষ ছাড়। ঋণের কিস্তির মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধেই খেলাপি মুক্তির সুবিধা পেয়েছে। এত সুবিধার পরও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে মন্দ ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশন) বা শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে অর্থ সংস্থানে ঘাটতিতে পড়েছে নয় ব্যাংক। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি নয় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২২ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। যার সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, বেসিক, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের। ঘাটতির তালিকায় আছে বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।
২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি নয় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২২ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। যার সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, বেসিক, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের। ঘাটতির তালিকায় আছে বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক
আমানতকারীর অর্থের নিরাপত্তায় ঋণের শ্রেণিমান বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত হারে ব্যাংকগুলোর মুনাফা থেকে অর্থ আলাদা করে রাখতে হয়, যাকে প্রভিশন বলে। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমানের বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

গত বছর মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করে নিয়মিত দেখিয়ে ঋণের বিপরীতেও পুরো সুদ আয় খাতে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় ব্যাংকগুলোকে। তবে ১৫ শতাংশ আদায় করে নিয়মিত দেখান ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত ২ শতাংশ প্রভিশন রাখতে বলা হয়।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এছাড়া যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে সরকারি চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৮ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনতা ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এর আগে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকটির ঘাটতি ছিল পাঁচ হাজার ১১৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে তিন মাসে দ্বিগুণের বেশি অর্থাৎ পাঁচ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।
ডিসেম্বর শেষে সরকারি চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৮ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনতা ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এর আগে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকটির ঘাটতি ছিল পাঁচ হাজার ১১৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে তিন মাসে দ্বিগুণের বেশি অর্থাৎ পাঁচ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে
এছাড়া সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণও জনতা ব্যাংকের। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৯ শতাংশ।
হঠাৎ করে জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। পরে লিখিত প্রশ্ন করা হলেও কোনো উত্তর দেননি।
প্রভিশন ঘাটতিতে জনতার পরই রয়েছে বেসিক ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১১৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যা আগের প্রান্তিকে ছিল তিন হাজার ৬৬৩ কোটি তিন লাখ টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি দুই হাজার ৬১৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা টাকা; সেপ্টেম্বরে ছিল দুই হাজার ১২৮ কোটি সাত লাখ টাকা। রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ২০৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। তিন মাস আগে ছিল ৯২২ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
বেসরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি তিন হাজার ৬১৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের, তিন হাজার ২৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। তিন মাস আগেও ছিল দুই হাজার ৩৮৫ কোটি ছয় লাখ টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ৩১৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা; তিন মাস আগে ছিল ৪৭১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ডিসেম্বরে নতুন করে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কমার্স (আইএফআইসি) ব্যাংক। ঘাটতি ২১২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ঘাটতি ২০৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে ছিল ১৫৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঘাটতি ১৪৯ কোটি টাকা। তিন মাস আগে ব্যাংকটির ঘাটতি ছিল ৯৯ কোটি টাকা।

খেলাপি কমাতে ঋণ পরিশোধে ঢালাও সুবিধা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ এক হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করে দুই লাখ ৩৩ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে মন্দ ও নিয়মিত ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮০ হাজার ৬৫৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করতে পেরেছে ৬৬ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। ফলে পুরো ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ১৪ হাজার সাত কোটি ২৪ লাখ টাকা। কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত (উদ্বৃত্ত) অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রাখায় সার্বিকভাবে এ খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম হয়েছে।
তিন মাসের ব্যবধানে জনতা ব্যাংকের পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রভিশন ঘাটতি হওয়া ‘অস্বাভাবিক’ মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যাংকটির একদিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, অন্যদিকে ঋণ আদায়ও তেমন করতে পারেনি। পাশাপাশি তাদের আয় কমেছে। এসব কারণে নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনের তুলনায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারেনি। তাই প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের ডিসেম্বর শেষে শ্রেণিকৃত ঋণের প্রভিশন রাখার কথা ছিল ১৪ হাজার ৮২১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে রেখেছে মাত্র চার হাজার ৩৩০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা।
এর আগে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শ্রেণিকৃত ঋণের প্রভিশন রাখার প্রয়োজন ছিল নয় হাজার ৫৯৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর বিপরীতে রাখা হয়েছিল চার হাজার ২৮১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ঘাটতি ছিল পাঁচ হাজার ৩১৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
এসআই/এমএআর/
