ঘুষ কেলেঙ্কারিতে কর্মকর্তারা, চুপ কেন্দ্রীয় ব্যাংক

রক্ষক যখন ভক্ষক। এমনই অভিযোগ উঠেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিরুদ্ধে। ঘুষের বিনিময়ে গুরতর অনিয়মে সহায়তা করেছে আরও বেশ কিছু কর্মকর্তা।
এ সুযোগে আর্থিক খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে কিছু সংঘবদ্ধ চক্র। আদালতে ঘুষ কেলেঙ্কারির স্বীকারোক্তি দিয়েছেন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি। অনিয়মের অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরাও। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গতানুগতিক একটি বিভাগ থেকে সরিয়ে আরেক বিভাগে পাঠানোর মাধ্যমে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে আর্থিক খাতের এ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।
জানা গেছে, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ অন্তত পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার)। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এসব অর্থ লোপাটের তথ্য গোপন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম। এসব অনিয়মের সহায়তা করত সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। বিনিময়ে পেত আর্থিক সুবিধা। ঘুষের বিনিময়ে এসব অনিয়মে সহায়তা করেছেন আরও বেশকিছু কর্মকর্তা।
আদালতে পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হকের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাশেদুল হক। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে আনে।
রাশেদুল হক আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে দিতো রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হতো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।
নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আসা এসব অভিযোগে সমালোচনার ঝড় ওঠে অর্থনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। কিন্তু যেসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেখভালের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে স্বাভাবিক নিয়মে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অনিয়ম তদন্ত করতে গঠন হয়নি কোনো কমিটি। এতে করে, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরাসহ খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাধারণ কর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, তাদের বেশিরভাগ কর্মী দক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করেন। দুই একজন কর্মকর্তার জন্য সবার বদনাম গ্রহণযোগ্য নয়। তাই যাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়নি বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক কর্মকর্তা। তারা বলছেন, এভাবে অনিয়মের অভিযোগ এড়িয়ে গেলে আগামীতে অন্যান্য কর্মকর্তারাও অনিয়মে জড়িয়ে পড়বেন।
পত্রিকার খবরের ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইমেজ রক্ষা ও আস্থা ধরে রাখতে দ্রুত দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইডিদের দায়িত্বে যে পরিবর্তন আসবে এটা স্বাভাবিক। অনেক সময় এ ধরনের পরিবর্তন হয়ে থাকে। শাহ আলমের বিষয়ে বিতর্ক হওয়ায় তার দায়িত্ব পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ তদন্ত করার জন্য এখনো কোনো কমিটি হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তা তদন্তে কোনো কমিটি হবে কি না জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করে আদালতে একজন ব্যক্তির স্বীকারোক্তি দিয়েছে। যা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আমরা জেনেছি। কিন্তু কোনো লিখিত তথ্য বা কাগজপত্র আমরা পাইনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে পত্রিকার খবরের ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ খুবই উদ্বেগজনক উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দায়িত্বশীল পদে থাকা একজন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। ওই কর্মকর্তার সিনিয়র বা উপরে দায়িত্ব থাকা এক দুইজনকে দিয়ে দ্রুত তদন্ত করুক। যদি অভিযুক্তরা কোনো ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকে তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, প্রথমে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে, পরে আইনত। প্রশাসনিক বললে তাদের নিজস্ব নীতিতে যে ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা নিবে। আর লিগ্যাল হলো এতে করে যদি কারো ক্ষতি হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেবে। এসব পদক্ষেপ দৃশ্যমান হতে হবে। যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইমেজ ক্ষুণ্ণ না হয়, মানুষ আস্থা না হারায়। কোনো মতেই বসে থাকা যাবে না- বলে জানান সাবেক এ গভর্নর।
ইডি শাহ আলমের নানা অনিয়মের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন অনিয়ম দুর্নীতিতে অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা। তাদের অভিযোগ পিপলস লিজিংয়ের বর্তমান পরিচালকদের যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটির এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও বর্তমান ইডি শাহ আলমের জড়িত। প্রায় দেড় বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রধান বিচারপতি, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সরকারের সংশ্লিষ্ট ১১টি প্রতিষ্ঠানে লিখিত আকারে এ অভিযোগ দেয়া হয়। ২০১৯ সালের ২৮ জুলাইয়ে দেওয়া লিখিত অভিযোগে ৭৬ জন আমানত, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারা স্বাক্ষর করেন। তবে এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসআই/ওএফ
