বন্ধ হচ্ছে সাভার রিফ্র্যাক্টরিজের কারখানা, লোকসানে বিনিয়োগকারীরা

Mahfuzul Islam

২০ আগস্ট ২০২২, ০৭:৪২ পিএম


বন্ধ হচ্ছে সাভার রিফ্র্যাক্টরিজের কারখানা, লোকসানে বিনিয়োগকারীরা

এক যুগ ধরে লভ্যাংশ দেয়নি বিনিয়োগকারীদের, আর লভ্যাংশ দেবেও না। শুধু তাই নয়, এখন কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিরামিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ লিমিটেড। এমনকি পুঁজিবাজার থেকেও অবসায়ন করবে কোম্পানিটি। এ অবস্থায় বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

সর্বশেষ গত বুধবার (১৭ আগস্ট) কোম্পানিটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের লেনদেন হয়েছে ২৬১ টাকা ১০ পয়সায়। কোম্পানি অবসায়ন হলে শেয়ার প্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) বিবেচনা করে শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন : পুঁজিবাজারে লেনদেন হবে ৩ লাখ কোটি টাকার বন্ড, মুনাফা দেবে ৮ শতাংশ

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানির প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ৭ পয়সা। অর্থাৎ শেয়ার প্রতি বিনিয়োগকারীরা ৭০ পয়সা সমমানের অর্থ পাবেন। এতে বিনিয়োগকারীদের পুরো টাকাই লোকসানের মুখে পড়বে।

কোম্পানিটির বর্তমান শেয়ার সংখ্যা ১৩ লাখ ৯২ হাজার ৮০০টি। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার গত বুধবার লেনদেন হয়েছে ২৬১ টাকা ১০ পয়সায়। তাতে কোম্পানির বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে রয়েছে কোম্পানির ৫০ দশমিক ৬৮ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ শেয়ার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৪২ দশমিক ১৪ শতাংশ শেয়ার

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি কোম্পানি এক যুগ ধরে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। ব্যবসা চলবে কি না তা দুই-চার বছরেই বোঝা যায়। তার জন্য ১২ বছর অপেক্ষা করতে হয় না। এমন অবস্থায় কোম্পানি অবসায়ন করতে চাচ্ছে। কোম্পানি বিক্রি করে দিলে বিনিয়োগকারীরা কিছুই পাবেন না। পরিকল্পিতভাবে কোম্পানিটি এ কাজ করেছে। বিএসইসির উচিত কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া।

এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যখন বোর্ডে ছিলাম তখন এই কোম্পানিকে ওটিসিতে পাঠানোর চেষ্টা করেছিলাম। ওটিসিতে থাকলে আজ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি কম হত।

আরও পড়ুন : পুঁজিবাজার ছেড়েছে ২ লাখ সাড়ে ১৯ হাজার বিনিয়োগকারী

তিনি বলেন, মূল মার্কেটে থাকায় কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন যারা এই কোম্পানির শেয়ার বেশি দামে কিনে আটকা পড়েছেন তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কেন বড় লোকসানে সাভার রিফ্র্যোক্টরিজ?

২০১০ সালের পর থেকে কোম্পানির উৎপাদন ও পণ্য বিক্রিতে ভাটা পড়ে। এরপর আস্তে আস্তে কমতে থাকে চাহিদা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চাহিদা কমায় উৎপাদন ক্ষমতা কমানো হয় ৫১ শতাংশ। এরপর কোম্পানির পরিচালনায় অদক্ষতায় লোকসানের দিকে যেতে শুরু করে। এটা বড় আকার ধারণ করে ২০১৯ সাল থেকে। এরপর করোনা এবং বিশ্ব মন্দার কারণে বিশ্ববাজার হারায় কোম্পানিটি।

সর্বশেষ কাঁচামাল আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে পণ্য উৎপাদন খরচ আরও বেড়েছে। যে টাকা দিয়ে পণ্য উৎপাদন করা হয়, বাজারে তার চেয়ে পণ্যের দাম কম। এ কারণে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসানই হয়েছে ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এই অবস্থায় কারখানা বন্ধের পাশাপাশি পুঁজিবাজার থেকে অবসায়নও চায় কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।

এ লক্ষ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে অবসায়নের জন্য আবেদন করেছে কোম্পানিটি।

ডিএসইর তথ্য মতে, অবসায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট দিয়ে অডিট করেছে। অডিটে জমি, প্লান্ট এবং যন্ত্রাপাতিসহ পুর্নমূল্যায়ন সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে।

২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছিল ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৫১ হাজার ২৫ টাকা। এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার ২৮০ টাকায়। অর্থাৎ পুনর্মূল্যায়নের সম্পদ মূল্য বেড়েছে ১৪ কোটি ১২ লাখ ২৭ হাজার ২৫৫ টাকা। সে হিসেবে কোম্পানির শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য আরও বাড়বে। তবে শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ পরিশোধের আগে কোম্পানি দায়-দেনা পরিশোধ করতে হবে।

যা বলছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ 

কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছেন, কাঁচামালের অভাবে কোম্পানি উৎপাদন খরচ যা বাজার মূল্য তার চেয়ে কম। ফলে কোম্পানিটিকে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হচ্ছে। লোকসান খেকে বেরিয়ে আসতে অবসায়নের বিকল্প নেই।

সার্বিক বিষয়ে কোম্পানি সচিব বেলায়াত হোসেন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববাজারে রপ্তানি বন্ধ, এখন দেশের বাজারের অবস্থা ভালো নয়। যে টাকা দিয়ে পণ্য উৎপাদন করতে হয়, বিক্রি হয় তার চেয়ে কম। ফলে বড় ধরনের লোকসান থেকে রক্ষা পেতে কারাখানা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কোম্পানিটিকে পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত আবেদন আমরা বিএসইসি ও ডিএসইকে দিয়েছি। বিএসইসি অনুমোদন দিলে দেনা-পাওনা পরিশোধ করা হবে। এনএভি অনুসারে শেয়ারহোল্ডারদের পাওনা বণ্টন করে দেওয়া হবে। একই সাথে শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতি নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন : পুঁজিবাজারের টাকা যাচ্ছে ডলার মার্কেটে!

বিবিধ খাতের ছোট মূলধনী কোম্পানিটি ১৯৮৮ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরের পর থেকে কোম্পানিটি শেয়াহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে। ১ কোটি ৩৯ লাখ ৩০ হাজার টাকার পরিশোধিত মূলধনী কোম্পানির ১৭ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে।

২০১০ সালের পর থেকে কোম্পানির উৎপাদন ও পণ্য বিক্রিতে ভাটা পড়ে। এরপর আস্তে আস্তে কমতে থাকে চাহিদা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চাহিদা কমায় উৎপাদন ক্ষমতা কমানো হয় ৫১ শতাংশ। এরপর কোম্পানির পরিচালনায় অদক্ষতায় লোকসানের দিকে যেতে শুরু করে। এটা বড় আকার ধারণ করে ২০১৯ সাল থেকে। এরপর করোনা এবং বিশ্ব মন্দার কারণে বিশ্ববাজার হারায় কোম্পানিটি।

কোম্পানির বর্তমান শেয়ার সংখ্যা ১৩ লাখ ৯২ হাজার ৮০০টি। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার বুধবার সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ২৬১ টাকা ১০ পয়সায়। তাতে কোম্পানির বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে রয়েছে কোম্পানির ৫০ দশমিক ৬৮ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ শেয়ার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৪২ দশমিক ১৪ শতাংশ শেয়ার।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার বক্তব্য

সার্বিক বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানির আবেদনটি যাচাই-বাছাই করা হবে। আইনগত দিকগুলো বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমআই/এসকেডি

Link copied