লুনা শামসুদ্দোহা : একজন অনুকরণীয় তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা

বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের অন্যতম পথিকৃৎ ও মেধাবী তথ্যপ্রযুক্তিবিদ লুনা শামসুদ্দোহা নারী উদ্যোক্তাদের কাছে অনুকরণীয় এক নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। ১৯৯২ সালে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যবসা শুরু করা ছিল তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ তিনি সাদরে গ্রহণ করে অর্জন করেছিলেন গর্ব করার মতো সাফল্য। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের প্রথম নারী চেয়ারম্যান ছিলেন লুনা শামসুদ্দোহা।
লুনা কেবল ব্যবসায়িক সাফল্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ড করে গেছেন সারাজীবন। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও বিকাশে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করেছেন।
লুনা শামসুদ্দোহার মধ্যে শিক্ষার বিকাশ কিংবা পেশাজীবীদের দক্ষতার উন্নয়নে কাজ করার তাগিদ ছিল সবসময়। তাই তো দেশের অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে এগিয়ে আসেন। অর্থনীতির মতো জটিল বিষয় নিয়ে কাজ করতে হলে সাংবাদিকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন এই উপলব্ধি থেকে তিনি ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) নিজস্ব অফিস স্থাপন ও ইআরএফ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন। তার এই অবদান আজ সাংবাদিকরা হৃদয় থেকে স্মরণ করে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে লুনা শামসুদ্দোহা একেবারে প্রথম থেকে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। সরকারের ই-জিপি সিস্টেমসহ অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান উল্লেখ করার মতো।
তিনি সবসময় বিশ্বাস করতেন আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন সম্ভব। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরো বেগবান করা যাবে। ২০১৬ সালে ভারতের কলকাতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতায় আয়োজিত ‘ইন্দো-এশিয়া কানেকটিভিটি ফর শেয়ারড প্রসপারিটি’ শীর্ষক সম্মেলনে তিনি এ নিয়ে চমৎকার নিবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি তার উপস্থাপনায় এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
লুনা শামসুদ্দোহা একাধারে দোহাটেক নিউ মিডিয়ার চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির (বিডব্লিউআইটি) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, আইসিটি শিল্প দক্ষতা পরিষদের পরিচালক, বেসিস পরিচালক এবং রাষ্ট্রায়াত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব পাওয়া তিনিই প্রথম নারী যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়াত্ত কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের আগে তিনি ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে জনতা ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রায়াত্ত আরেক ব্যাংক অগ্রণী ব্যাংকেরও পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ বিজনেস ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা এবং সুইজারল্যান্ডের গ্লোবাল থট লিডার অন ইনক্লুসিভ গ্রোথের সদস্য ছিলেন।
২০১৩ সালে প্রযুক্তি খাতে নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও নারীর ক্ষমতায়নে গ্লোবাল উইমেন ইনভেন্টরস অ্যান্ড ইনোভেটরস নেটওয়ার্ক সম্মাননা লাভ করেন লুনা। দেশের অর্থনীতিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড-২০১৭। এছাড়া একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে স্থানীয় সফটওয়্যার শিল্পে নিজের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে লুনা শামসুদ্দোহা অনন্যা টপ টেন অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
১৯৫৪ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন লুনা শামসুদ্দোহা। তার বাবার নাম লুৎফার রহমান এবং মায়ের নাম হাসিনা রহমান। তিনি ভিকারুননিসা নুন স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি এবং হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
১৯৮৫ সালে দ্য এক্সিকিউটিভ সেন্টারের ব্যবস্থাপনা সহযোগী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন লুনা সামসুদ্দোহা। পরে তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিলে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচালক ছিলেন।
তার প্রতিষ্ঠান দোহাটেক নিউ মিডিয়া সফটওয়্যার ও সিস্টেম ডেভলপমেন্টের কাজ করে। এ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ভুটান, মালদ্বীপ, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সংস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনের জন্য সফটওয়্যার সলিউশন দিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের পোস্টাল সার্ভিস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও দোহাটেক নিউ মিডিয়া ডিজিটাল সার্টিফিকেট প্রদান করার জন্য নির্বাচিত একটি প্রতিষ্ঠান।
লুনা শামসুদ্দোহার স্বামী ব্যবসায়ী এ কে এম সামসুদ্দোহা। এ দম্পতির একমাত্র সন্তান রিম সামসুদ্দোহা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রণী এই উদ্যোক্তা ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অসংখ্য মানুষকে অশ্রু সাগরে ভাসিয়ে মায়াময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আজ তার ৬৫তম জন্মদিনে উদারচেতা স্বপ্নবান মানুষটির আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তিনি তার কর্মগুণে মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন। গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি ও ধন্যবাদ জানাই বেসিসকে। সংগঠনটি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশেষ অবদানের কথা স্মরণে রেখে চলতি বছর থেকে ‘বেসিস লুনা শামসুদ্দোহা অ্যাওয়ার্ড’ চালু করেছে।
পরিশেষে বলতে চাই- ‘নাম মানুষকে বড় করে না, কর্ম মানুষকে বড় করে তোলে’। এই মহান উক্তিটি প্রয়াত লুনা শামসুদ্দোহার ক্ষেত্রে স্বার্থকতা পেয়েছে। প্রিয় এই মানুষের জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
লেখক : এস এম রাশিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)।