নামমাত্র কোম্পানির পেছনে ছুটছেন বিনিয়োগকারীরা

নামেই শুধু কোম্পানি। নেই কারখানা, যন্ত্রপাতি কিংবা সরঞ্জাম। আবার কারখানা থাকলেও কার্যক্রম বন্ধ, তাই দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদনহীন। খুব শিগগির কোম্পানির ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো সম্ভবনাও নেই। তবু এমন কোম্পানির শেয়ারের পেছনে ছুটছেন বিনিয়োগকারীরা। আর তাতে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে। বিষয়টিকে পুঁজিবাজার এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার সময় অনেক মুনাফা দেখিয়েছে। তালিকাভুক্ত হয়ে এক-দুই বছর ভালো লভ্যাংশও দিয়েছে। এরপর এসব কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা শেয়ার বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়ার পাশাপাশি নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে নামমাত্র কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এমন কোম্পনিগুলো হলো- বিমান ও পর্যটন খাতের কোম্পানি ইউনাইটে এয়ারওয়েজ বিডি, রিং শাইনিং, বিডি ওয়েল্ডিং, ফাইন ফুড, বিচ হ্যাচারী, ফ্যামেলিটেক্স, এমারল্ড অয়েল, সিএনএ টেক্স, ঢাকা ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড ও ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে ভুয়া আর্থিক প্রতিবেদন দিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তালিকাভুক্ত হওয়ার পরপরই কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে হাতে থাকা শেয়ারগুলো বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এখন আবার এসব কোম্পানির পেছনে ছুটছেন লোভী বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানিগুলোতে নতুন করে যারাই বিনিয়োগ করবেন, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই উৎপাদনহীন, দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কয়েকটি কোম্পানি নামমাত্র কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কোম্পানিগুলোর দিকে আমরা নজর দিয়েছি।
‘কয়েকটি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি কোম্পানিতে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। নতুন পর্ষদ যদি কোম্পানিকে মুনাফায় আনতে পারে তাহলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা উচিত। তা না হলে এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না।’
এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্ঠা অধ্যাপক ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদনহীন ও কারখানা বন্ধ থাকা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা কোনো সচেতন বিনিয়োগকারীর কাজ নয়। এসব কোম্পানিতে যারা বিনিয়োগ করবেন, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
কোম্পানির বক্তব্য
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদ-উল-আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্ধ কোম্পানি চালু করতে কাজ করছি। কাজটা খুব সহজ নয়। এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করবে কি করবে না এটা বিনিয়োগকারীদের বিষয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিওয়েল্ডিংয়ের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কারখানা স্থানান্তরের কারণে এখন আমাদের কোনো কার্যক্রম নেই। কোম্পানির নতুন কারখানা স্থাপন কবে হবে নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
কোন কোম্পানি কী অবস্থা
বিডিওয়েল্ডিং : ১৯৯৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির কোনো কারখানা নেই। সাভারের ধামরাইয়ে একটি জমিতে কোম্পানির পুরাতন সাইন বোর্ড ঝুলছে। ভালো মুনাফা দেখিয়ে পুঁজিবাজারে আসা এ কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে। বর্তমানে কোম্পানিটির কোনো কারখানা, যন্ত্রপাতি কিংবা কোনো সরঞ্জাম নেই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই এসময়ে শেয়ারের দাম বাড়ছে। ডিএসইর তথ্য মতে, সর্বশেষ রোববার (১৪ মার্চ) ১৬ টাকা ৫০ পয়সায় কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ : উচ্চদামে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার ছাড়েন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের উদ্যোক্তা-পরিচালকরা। ফলে ২০১৫ সালের পর থেকে বন্ধ রয়েছে উড়োজাহাজ ওড়া। একদিকে আকাশে উড়োজাহজ ওড়া বন্ধ, অন্যদিকে কোম্পানির ঋণ বেড়েই চলেছে। এদিকে দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ থাকায় শাস্তি স্বরুপ ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে ওভার দ্যা কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে পাঠায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবু কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ছে।
ডিএসইর তথ্য মতে, বৃহস্পতিবারও শেয়ারটির দাম বেড়েছে ৩০ পয়সা। এদিন কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২ টাকা ৩০ পয়সায়। এর আগের ছিল ২ টাকা। অর্থাৎ ১৫ শতাংশ বেড়েছে।
কোম্পানি তথ্য মতে, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটিকে উৎপাদনে ফেরাতে কাজী ওয়াহিদ-উল-আলমের নেতৃত্বে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। কোম্পানিটিতে কাজী ওয়াহিদ-উল-আলম, এম সাদিকুল ইসলাম, মো. মাকসুদুর রহমান সরকার, নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক বদরুজ্জামান ভুঁইয়া, মোহাম্মদ ইউনুস এবং মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর তাতে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম বাড়ছে।
বর্তমানে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে রয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৫০ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ১১ দশমকি ৭ শতাংশ শেয়ার। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৮৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ শেয়ার।
এমারল্ড অয়েল : কোনো কারণ ছাড়াই ৯ টাকার ৬০ পয়সার শেয়ারটির দাম গত ২৩ ফেব্রয়ারি থেকে বাড়তে থাকে। ৩ মার্চ পর্যন্ত শেয়ারটির দাম ৩ টাকা ৭০ পয়সা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ১৩ টাকা ৩০ পয়সায়। ২০১৪ সালে তালিকাভুক্ত এমারল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৩০ দশমিক ৪৫ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ শেয়ার আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৫৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ শেয়ার।
গত চার বছর ধরে কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন উদ্যোক্তা-পরিচালকরা। বাজারে পণ্যের চাহিদা থাকলেও ২০১৮ সাল থেকে কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে কোম্পানিও বড় লোকসানে পড়েছে।
কোম্পানটিকে মুনাফায় ফেরাতে পুরনো পর্ষদ ভেঙে পাঁচ নতুন স্বতন্ত্র পরিচালকের নেতৃত্বে পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সাবেক সিনিয়র সচিব শহিদুল হককে কোম্পানির চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়েছে। অন্য চার পরিচালক হলেন- বিআইবিএমের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মাদ গোলাম সারোয়ার ও সজিব হোসেন এবং মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার দে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে এ খবরে গত ৩ মার্চ পর্যন্ত শেয়ারের দাম বেড়েছে। এ দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ কোম্পানির কারখানা আছে নামে মাত্র। কারখানায় কোনো উৎপাদন নেই।
সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল : অধিক মুনাফা দেখিয়ে ২০১৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। তালিকভুক্তির দুই বছরের মধ্যে উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রি করে দেয় উদ্যোক্তা-পরিচালকরা। ২০১৭ সাল থেকে কোম্পানিটি লোকসানের মুখে পড়ে। বর্তমানে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের বস্ত্রখাতের কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১ টাকার ৯০ পয়সা থেকে ২ টাকার ৬০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
ফ্যামিলিটেক্স বিডি : অধিক মুনাফা দেখিয়ে ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে আসা কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে ২০১৮ সালের পর থেকে। ইউনাইটেড এয়ারসহ অন্যান্য কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের মতোই এ কোম্পানির পরিচালকরা উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ফলে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারটির দাম ২ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে এসেছে।
এ কোম্পানির দৃশ্যমান একটি কারখানা আছে কিন্তু কোনো কার্যক্রম নেই, কারখানায় নষ্ট হচ্ছে সম্পদ। এ অবস্থায়ও কোম্পানিটির শেয়ারের দাম গত ২৫ জানুয়ারি থেকে বাড়তে থাকে। ২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বেড়ে ৩ মার্চ পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে ৩ টাকা ১০ পয়সায়।
কোম্পানির তথ্য মতে, ২০১৬ সালে কোম্পানিটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ এবং চেয়ারম্যান রোকসানা শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার পর কোম্পানিটি লোকসানে চলে আসে। কোম্পানির পেইড আপ ক্যাপিটালের ৪ দশমিক ২ শতাংশের নিচে চলে আসে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ।
কোম্পানিকে মুনাফায় ফেরাতে সম্প্রতি কাজী আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। পর্ষদের অন্য পরিচালকরা হলেন- ড. সামির কুমার শীল, ড. গাজী মোহাম্মদ হাসান জামিল, ড. মো. জামিল শরিফ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরিফ এহসান এবং ড. মো. ফরজ আলী।
রিংসাইন টেক্সটাইল : অনেক মুনাফা হবে এমন তথ্য দিয়ে ২০১৯ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া টেক্সটাইল কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে ২০২০ সাল থেকে। এরপরও কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ছে।
এদিকে কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ থাকার পাশাপাশি মুনাফায় থাকা কোম্পানি হঠাৎ লোকসানে পড়ায় এবং ব্যবস্থপনায় কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না তা অনুসন্ধানের জন্য হুদাভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বিএসইসি। পাশাপাশি নতুন পর্ষদও গঠন করেছে। কোম্পানিটিও পুনর্গঠন করা হয়েছে।
কোম্পানির তথ্য মতে, ঢাকার সাভারের ডিইপিজেডে অবস্থিত রিংসাইন কোম্পানিটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। তারপর মাত্র ৯ মাসের মাথায় ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে কাঁচামাল ও রফতানি সংকট দেখিয়ে কোম্পানিটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
বিচহ্যাচারী : ২০০২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তারপরও শেয়ারের দাম বাড়ছে। ২০১৪ সালের পর থেকে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিতে না পারা কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১৩ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে ১৪ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
একই অবস্থায় রয়েছে ফাইনফুড লিমিটেড কোম্পানিটিও। ঢাকার নিউমার্কেটে একটি ভাড়া অফিস থাকলেও কোম্পানিটির কারখানা নেই। তারপরও কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ছে।
এমআই/এসএসএইচ
