দক্ষতার ঘাটতি ও ঋণে জটিলতা এসএমই খাতের বড় চ্যালেঞ্জ

প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী দেশগুলোর জিডিপিতে যেখানে এসএমই খাতের অবদান ৪০-৬০ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের জিডিপিতে এ খাতের অবদান এখনো ৩০ শতাংশেরও কম। অর্থাৎ আমরা এসএমই খাতে অনেক পিছিয়ে রয়েছি। অথচ লার্জ ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখতে একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে এসএমই খাতের বিকল্প নেই। তাই এসএমই খাতকে এগিয়ে নিতে ব্যাংকিং ফাইনান্সকে সহজতর করা, মার্কেট সম্পর্কে জানতে ও ডকুমেন্টেশন তৈরির জন্য দক্ষতা বাড়িয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া, এএসএমই জন্য আলাদা সেল বা মন্ত্রণালয় তৈরি করা ও প্রয়োজনীয় পলিসি সাপোর্ট দেওয়া প্রয়োজন। এসব করা সম্ভব হলে এসএমই খাতের ব্যাপক সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী করবে।
সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘অপরচুনিটিস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ ইন দ্য এসএমই সেক্টর’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন। তবে এগুলোর পাশাপাশি ব্যাংকারদের মানসিক পরিবর্তনও দরকার বলেও তারা মনে করেন, যাতে ব্যাংকাররা সত্যিকারের মমতা নিয়ে এ খাতের উন্নয়নে অর্থায়নগুলো দেখভাল করে।
রাজধানীর পুরোনো পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন ইআরএফের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, উন্নত দেশগুলোতে বড় উৎপাদকরা ব্যাংক ওয়ার্ড লিংকেজগুলো ছোট উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে কিনে নেয়। ফলে একই শিল্পে ছোট বড় উদ্যোক্তা তৈরি হয়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেমন টয়োটা গাড়ির ইঞ্জিনটা তৈরি করে বাকি সব পার্টস বাইরে থেকে তৈরি করে নেয়।
তিনি বলেন, কিন্তু আমাদের দেশে বড়রা ছোটদের সুযোগ দেয় না, তারা নিজেরাই সবকিছু তৈরি করে। অনেক বড় গ্রুপ চানাচুর-মুড়িও তৈরি করে। এই বৈষম্য দূর কর করতে ছোট উদ্যোক্তাদের ব্যাংকের অর্থায়ন দরকার। কিন্তু এসএমই উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় অর্থায়ন পাচ্ছে না। এ খাতে অর্থায়ন এখনো বড় সমস্যা। প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে অনেক তহবিল থাকলেও প্রকৃত হকদাররা তা পাচ্ছে না। যারাই পাচ্ছে তাদের ইন্টারেস্ট রেটও ১২-১৪ শতাংশ হয়ে যায়।
এছাড়া এসএমই খাতের জন্য ১ শতাংশ সোর্সটেক্স রয়েছে যা থাকা উচিত নয় জানিয়ে মাহবুবুল আলম বলেন, আমরা অনেক চেষ্টা করছি যাতে সরকার এটি তুলে নেয়। কারণ এসএমই উদ্যোক্তাদের যদি সুযোগ না দেওয়া হয় তাহলে দেশের অর্থনীতি বড় হবে না। স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হলে এসএমইয়ের কোনো বিকল্প নেই। দেশকে এগিয়ে নিতে এসএমইকে এগিয়ে নিতে হবে। পেছনে ফিরে দেখার সময় নেই, বড় চিন্তা করতে হবে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, এসএমই খাতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সাইকোলজিক্যাল সমস্যা রয়েছে। একটি ঋণে অনেক কাগজপত্র দরকার হয়। কিন্তু ব্যাংকার, উদ্যোক্তারা এ বিষয়ে আগ্রহী হন না। দক্ষতার ঘাটতি এর অন্যতম কারণ। এই আগ্রহের ঘাটতিতে এসএমই খাত পিছিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে ব্যাংক এসএমই খাতের জন্য ঋণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সেটি অর্জন চ্যালেঞ্জিং।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সামির সাত্তার বলেন, এসএমই খাতের জন্য এক্সসেস টু ফাইনান্স ছাড়াও এখন বড় চারটি পদক্ষেপ দরকার। এগুলো হলো- মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজকে এসএমই থেকে বের করে দেওয়া, যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই খাতকে টেনে তুলতে ট্যাক্স মৌকুফ এবং এলসি মার্জিন লেয়ার তৈরিসহ নানা ধরনের সরকারি পলিসি সাপোর্ট দেওয়া। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের উপযোগী করে গড়ে তুলতে উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া ও আলাদা এসএমই মন্ত্রণালয় তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, এসএমই খাতের জন্য পলিটিক্যাল উইল দরকার, যাতে সরকার এসএমই খাতকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে পারে। কারণ বড় ইন্ড্রাস্ট্রিগুলো এসএমই ছাড়া টিকে থাকতে পারবে না। এছাড়া এসএমই উদ্যোক্তারা বেশি দারিদ্র্য বিমোচন করেন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের এমডি মাসুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের এসএমই খাত প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে। কারণ অর্থায়নে ঘাটতি আছে এবং সুদ হার বেশি। প্রত্যেক ক্ষেত্রে এসএমই খাত বাধার মুখে পড়ছে। এসএমই খাতের জন্য একটি ইনডিজিনিয়াস লোন প্রসেস তৈরি করতে হবে। কীভাবে সহজে ঋণ দেওয়া হবে সেজন্য উদ্ভাবনী আইডিয়া দরকার।
তিনি বলেন, এসএমই খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাজার প্রবেশাধিকার সহজ করতে হবে। অনেক সময় মধ্যস্বত্ত্বভোগীর কারনে এসএমই উদ্যোক্তারা মার্কেটে ঢুকতে পারে না। মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা উদ্যোক্তাদের বড় হতে দেয় না। প্রকৃত উদ্যোক্তারা তাদের জন্য বাজারজাত করতে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীল থাকে।
তিনি বলেন, এছাড়া কমপ্লায়েন্স বাড়াতে হবে। সামনে অনেক অপরচুনিটি রয়েছে সেগুলো ধরতে হলে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। এসব কিছুর জন্য উদ্যোক্তাদের ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের বিকল্প নাই। ফেসবুকের সঙ্গে এসএমই ফাউন্ডেশনের চুক্তি হয়েছে। ফেসবুক উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা তাদের মার্কেটিং ও প্রচারণা করতে পারেন।
এসআই/কেএ