তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিতে হবে
তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে সিগারেটসহ সব তামাকপণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। এজন্য সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে সিগারেটসহ সব তামাকপণ্যের দাম বাড়ানো জরুরি।
সোমবার (১০ মে) তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টিটোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স-আত্মা’র যৌথ উদ্যোগে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে তামাক কর ও মূল্য পদক্ষেপ: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে এমন সুপারিশ করেছেন সংসদ সদস্য, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, কার্যকরভাবে করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম বাড়ালে তরুণ জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হয় এবং বর্তমান তামাক ব্যবহারকারী বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়।
ভার্চুয়াল সভায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, তামাকের দাম বাড়ানো হলে গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এনবিআরের এই বক্তব্য খুবই হতাশাজনক। বরং তামাকপণ্যের দাম বাড়ানো হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। তিনি এ বছরের তামাক-কর বিষয়ক বাজেট প্রস্তাব সমর্থন করে তামাকের রফতানি শুল্ক পুনর্বহালেরও দাবি জানান।
অনুষ্ঠানে প্রজ্ঞা’র পক্ষ থেকে তামাক কর বিষয়ক ‘বাজেট প্রস্তাব ২০২১-২২’ তুলে ধরে বলা হয়, এই বাজেট প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে প্রায় ১১ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে, ৩ লাখ ৯০ হাজার বর্তমান ধূমপায়ী এবং ৪ লাখ তরুণের অকাল মৃত্যু রোধ হবে এবং সিগারেট থেকে সম্পূরক শুল্ক, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ এবং ভ্যাট বাবদ অতিরিক্ত ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, আমরা প্রতিবছরই সরকারের কাছে দাবি জানাই তামাকের কর বাড়ানোর জন্য, কিন্তু বাজেটে তার প্রতিফলন দেখি না। আমাদের সংবিধানে বলা আছে প্রজাতন্ত্রের মালিক হচ্ছে জনগণ আর রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ভেবে চিন্তেই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যারা এই ঘোষণার অন্তরায় হিসেবে কাজ করছেন তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
বাসসের চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমি আশা করি এবারের বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন তারা তামাকপণ্যের কর বাড়ানোর এই দাবি কিছু না কিছু পূরণ করবেন। এর পাশাপাশি তিনি নতুন প্রজন্মকে তামাক থেকে দূরে রাখার জন্য পাঠ্যক্রম এবং সহশিক্ষা পাঠ্যক্রমে তামাকের কুফল অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, কর বাড়িয়ে সিগারেটের সহজলভ্যতা যদি কমানো যায় তাহলে বিশেষ করে যারা দরিদ্র মানুষ তারা এই অর্থ পুষ্টিকর খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যয় করতে পারবে। তিনি তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন, যেখানে কর বাড়ানোর পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানো এবং আইন বাস্তবায়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমদ বলেন, তামাক-কর বিষয়ক বাজেট প্রস্তাব বাস্তবায়নে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে বিএটিবিতে সরকারের অংশীদারিত্ব এবং এনবিআরে তামাক কোম্পানির প্রভাব। আগামী বাজেটে তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি তামাক কোম্পানিতে সরকারের প্রতিনিধিত্ব প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং টিভি টুডে’র এডিটর ইন চিফ মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বেশি কাজ করতে হবে। কিন্তু সেটি আমরা দেখছি না। এবিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
দৈনিক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, বিড়ি-সিগারেট ব্যবহারের কারণে লোকজন অসুস্থ হয় এবং চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে এবং এ কারণে দারিদ্র্য আরও বাড়ে। এই বিষয়ে বেশি প্রচারণা এবং সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক বলেন, আমরা তামাকপণ্যে কর বাড়াতে চাই, কারণ এতে নিম্নআয়ের মানুষের কাছে এসব পণ্যের সহজলভ্যতা কমে এবং তরুণরা তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হয়। এছাড়াও তামাক ইন-ইলাস্টিক জাতীয় পণ্য হওয়ায় কর বাড়ালে সরকারের রাজস্ব বাড়বে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এর রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তা মোট সিগারেট ধূমপায়ীর প্রায় ৭০ শতাংশ। সুতরাং সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে এই স্তরের দাম বাড়িয়ে মধ্যম স্তরের কাছাকাছি নিতে পারলে সিগারেটের ব্যবহার যেমন কমবে, তেমনি সরকারের রাজস্ব কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে) বাংলাদেশ এর লিড পলিসি অ্যাডভাইজর মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তামাকপণ্যের দাম বাড়লে দরিদ্র মানুষ তামাক ব্যবহার থেকে সরে আসে। তামাকপণ্যে করারোপ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আরও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করার ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
আত্মা’র কো-কনভেনর নাদিরা কিরণের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রজ্ঞা’র তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার। এছাড়া গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন আত্মা’র কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন, প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়েরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতারা।
আরএম/জেডএস