৩ লাখ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অনিবন্ধিত, অবৈধ লেনদেন ৫০ হাজার কোটি

দেশে বর্তমানে ই-কমার্স ও এফ-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন লাখের বেশি। অথচ যার মধ্যে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র এক হাজার ৪৯৬টি। বাকি প্রায় ২ লাখ ৯৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। অনিবন্ধিত এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন লাখ লাখ পণ্য অর্ডার ও ডেলিভারি দিচ্ছে। বিপরীতে সরকার কোনোই রাজস্ব পাচ্ছে না।
অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ উপায়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহক থেকে টাকা নিচ্ছে, যেখানে অবৈধ লেনদেনের পরিমাণ অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি গ্রাহকরা প্রতারণার শিকারও হচ্ছেন।
আরও পড়ুন
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। ইতোমধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠানের ৬৬১ কোটি টাকার বেশি পাচারের তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আনন্দের বাজার (৩০০ কোটি), ই-অরেঞ্জ (২৩২ কোটি), ধামাকা (১১৬ কোটি), রিং আইডি (৩৭ কোটি ৪৯ লাখ), টোয়েন্টি ফোর টিকিট লিমিটেড (৪ কোটি ৪৪ লাখ), এসপিসি ওয়ার্ল্ড (১ কোটি ১৭ লাখ), সিরাজগঞ্জ শপ (৪ কোটি ৯ লাখ), আকাশনীল ডট কম (৩ কোটি) রয়েছে। সিআইডি এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আর রাজস্ব ফাঁকি নিয়ে কাজ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গোয়েন্দা ইউনিট।

এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ও পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে প্রতিনিয়ত অনলাইনে কেনাকাটা বাড়ছে। প্রতারকচক্র নতুন নতুন কৌশলে প্রতারণা করছে। আমাদের কাছেও বিভিন্ন সময়ে তথ্য-উপাত্ত আসে। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা ইউনিটের তথ্য-উপাত্ত এনবিআর গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে।
বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেট ডট কমের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৬ সালে দেশে ই-কমার্স বাজার ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে।
ই-ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় ৬-৭ লাখ ডেলিভারি হয়। প্রতিটি ডেলিভারিতে গড়ে ১,৪০০ টাকা লেনদেন হয়, যার ২৫ শতাংশ বাজার রয়েছে ফেসবুক উদ্যোক্তাদের দখলে। বর্তমানে দেশে প্রায় পাঁচ লাখ ই-কমার্স উদ্যোক্তা রয়েছেন।

এসবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন, যার মধ্যে ১০ শতাংশ বা এক কোটি ব্যবহারকারী ই-কমার্স বা অনলাইনে অর্ডার বা সেবা নিয়ে থাকেন। প্রায় সাড়ে তিন লাখ ফেসবুক পেজ রয়েছে যারা ফেসবুকে এবং ইনস্টাগ্রামে ব্যবসা করেন, তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ ছোট উদ্যোক্তা, ৪ শতাংশ মাঝারি ও ১ শতাংশ বড় প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে বৈধভাবে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছিল প্রায় ৫ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে লেনদেন দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ১১২ কোটি টাকায়। তবে, অবৈধ লেনদেন হিসাব করলে তা ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
তদন্ত শেষে আটটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিআইডি। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মোট ৬৬১ কোটি ৫১ লাখ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে
গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দেশে তিন লাখের বেশি ই-কমার্স সাইট ও ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স ব্যবসা রয়েছে। তবে ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমে (ডিবিআইডি) নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান মাত্র ১,৪৯৬টি, বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো নিবন্ধিত নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিদিন লাখ লাখ পণ্যের অর্ডার ও ডেলিভারি হচ্ছে, ফলে সরকার বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।

রাজস্ব ক্ষতির বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ই-কমার্স খাতে সরকারের বিশাল রাজস্ব হারানোর একটি বড় কারণ হলো নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকা অনানুষ্ঠানিক ব্যবসার আধিক্য। নিবন্ধিত নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনো রাজস্ব আসে না। এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।
ই-কমার্স এবং এফ-কমার্স ব্যবসার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়লেও কিছু কর্মকাণ্ড এবং প্রতারণার কারণে গ্রাহকদের হতাশা বেড়েছে। প্রতারকচক্র বিভিন্ন কৌশলে গ্রাহকদের প্রতারিত করছে, যেমন ভুয়া সাইট তৈরি করে টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করা, ডেলিভারি চার্জের নামে টাকা নেওয়া, উন্নত পণ্যের ছবি দেখিয়ে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করা।
প্রতিবেদনে ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতারণা ও রাজস্ব ফাঁকি রোধে সাতটি সুপারিশ করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম- অনিবন্ধিত ই-কমার্স সাইট ও এফ-কমার্স পেজ শনাক্ত করে বাধ্যতামূলক ডিবিআইডি নিবন্ধন নিশ্চিত করা, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন, সব ডিজিটাল কমার্স লেনদেনের জন্য ‘এসক্রো’ সার্ভিস চালু, নিবন্ধিত ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ক্ষেত্রে এমএফএস কোম্পানির চার্জ কমিয়ে আনা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা, ২০২১ অনুযায়ী, দেশে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট নিবন্ধন, ই-টিআইএন, পারসোনাল রিটেইল একাউন্ট (পিআরএ) অথবা ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (ডিবিআইডি) এর অন্তত একটি নিবন্ধন গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। এছাড়া, নিবন্ধনটি মার্কেটপ্লেস বা সোশ্যাল মিডিয়া পেজ-এ প্রদর্শন করতে হবে। তবে, বেশিরভাগ ই-কমার্স সাইট এবং ফেসবুক পেজে এসব নিবন্ধন প্রদর্শন করা হয় না। এর ফলে, ভোক্তারা ভুয়া ও ভুঁইফোড় সাইট থেকে পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন বলে গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তদন্ত শেষে আটটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিআইডি। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মোট ৬৬১ কোটি ৫১ লাখ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
সংস্থাটির প্রতিবেদনে ই-কমার্স ও এফ-কমার্স সাইটে প্রতারণার কিছু কৌশল তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ফেসবুক পেজ ও আইডিতে ফেক রিভিউ, কৃত্রিমভাবে অধিক লাইক-কমেন্ট, টাকার বিনিময়ে প্রমোশনাল ইনফ্লুয়েন্সার এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ছবি অবৈধভাবে ব্যবহার করে প্রমোশনাল ভিডিও বা ছবি তৈরি করা। এসব কৌশল গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে এবং প্রতারণার সুযোগ সৃষ্টি করে।
প্রতারণার যত কৌশল
বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। এই প্রতারণার ক্ষেত্রে শুরুতেই ফেসবুকে একটি পেজ খুলে অথবা ব্যক্তিগত আইডি থেকে ভুয়া রিভিউ, কৃত্রিমভাবে অতিরিক্ত লাইক-কমেন্ট তৈরি, টাকার বিনিময়ে প্রমোশনাল ইনফ্লুয়েন্সার ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ছবি অবৈধভাবে ব্যবহার করে প্রমোশনাল ছবি-ভিডিও তৈরি করে।
এতে গ্রাহকরা আকৃষ্ট হয় এবং প্রতারণার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এরপর পণ্যের লোভনীয় অফার/মূল্যছাড় দিয়ে বিজ্ঞাপন বানিয়ে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
আরেক ধাপে পণ্যের বিপরীতে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসের (বিকাশ, নগদ, রকেট, ইউক্যাশ, শিওরক্যাশ) মাধ্যমে গ্রহকের কাছ থেকে টাকা নেয়। গ্রাহকের আগ্রহ বেশি থাকলে পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য অগ্রিম নিয়ে নেয়। এ ছাড়া ক্যাশ অন ডেলিভারির কথা বলে ডেলিভারি চার্জ ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ১০ থেকে ২০ শতাংশ মূল্য নিয়ে থাকে। এরপর অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের, নষ্ট, কম দামি, নকল বা ভিন্ন পণ্য সরবরাহ করে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের অনুসন্ধানে এসব চিত্র উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এফ-কমার্সের ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগেরই নিবন্ধন নেই। লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা অবৈধভাবে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ব্যবহার করে। নিজের কোনো এমএফএস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার না করে তার অবস্থানকৃত এলাকার এমএফএস এজেন্টের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এজেন্টের নম্বরে ক্যাশআউট অথবা সেন্ডমানি করে। প্রাপক তার ব্যক্তিগত তথ্য ছাড়াই টাকা সংগ্রহ করে। মোবাইল ফোন অপারেটর কম্পানিগুলোর অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশে অন্যের নামে বিকাশ রেজিস্ট্রেশনসহ নিবন্ধিত সিম উচ্চমূল্যে প্রতারকদের সরবরাহ করে। ফলে সেই নম্বরের সিডিআর ও এনআইডি বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।
এর আগে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকম, আলেশামার্ট, দালাল প্রাসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সুলভ মূল্যে পণ্য বিক্রির কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অগ্রিম টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে গ্রাহকের হাতে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর কাছে অর্থ আটকে রাখার সার্কুলার জারি করে। ফলে গ্রাহকদের অগ্রিম অর্থ পেমেন্ট গেটওয়েগুলোতে আটকে যায়। বেশির ভাগ গ্রাহক এখন পর্যন্ত পেমেন্ট গেটওয়েগুলোতে আটকে থাকা অর্থ ফেরত পাননি।
গ্রাহকের আস্থা অর্জনের জন্য ভুয়া এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন কার্ডের ছবি পাঠানো হয়। হোয়াইটসঅ্যাপ-এ অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করা হয়, যার ফলে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী প্রতারকদের শনাক্ত করতে পারে না।
গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি ও সিম বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান-এর অসৎ কর্মকর্তারা অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম সরবরাহ করছেন, যা প্রতারকদের জন্য কার্যকরী হয়ে উঠছে। এতে, সিডিআর ও নিবন্ধিত এসআইডি বিশ্লেষণ করে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
তাই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতারণা ও রাজস্ব ফাঁকি রোধে অনিবন্ধিত ই-কমার্স সাইট ও এফ-কমার্স পেজ শনাক্ত করে বাধ্যতামূলক ডিবিআইডি নিবন্ধন নিশ্চিত করা, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন, সব ডিজিটাল কমার্স লেনদেনের জন্য ‘এসক্রো’ সার্ভিস চালু, নিবন্ধিত ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ক্ষেত্রে এমএফএস কোম্পানির চার্জ কমিয়ে আনার সুপারিশ রয়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ই-কমার্স ক্ষেত্রের প্রবৃদ্ধি হলেও অনলাইন প্রতারণা, পণ্য পরিবহনে বাধা, নকল পণ্য ও সাইবার অপরাধের কারণে বিনিয়োগকারীর আস্থা ধস নেমেছে। অথচ আগামীর সম্ভাবনার প্লাটফর্ম হচ্ছে এই খাত।
আরএম/এমএসএ
