বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা, ‘ভয় নেই’ বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদ ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করেছে। খুব শিগগিরই রাষ্ট্রপতির অনুমতি-সাপেক্ষে অধ্যাদেশটি জারি করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। নতুন এ অধ্যাদেশ নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে, এটির বাস্তবায়ন কীভাবে হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যাংকাররা।
নতুন আইনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল কোনো ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণসহ অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে। এছাড়া, বর্তমান কিংবা নতুন শেয়ারধারকের মাধ্যমে মূলধন বাড়ানোর পাশাপাশি ওই ব্যাংকের শেয়ার, সম্পদ ও দায় তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তরেরও সুযোগ থাকছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। রেজল্যুশন আইন ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি কিংবা ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম চালিয়ে রাখতে প্রয়োজন হলে এক বা একাধিক ব্রিজ ব্যাংক গঠন করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে এসব ব্রিজ ব্যাংক তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে কোনো দুর্বল ব্যাংকের সবধরনের লেনদেন বা কার্যক্রম সর্বোচ্চ দুই কার্যদিবসের জন্য বন্ধ রাখতে পারবে। আংশিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা যাবে সর্বোচ্চ তিন মাস পর্যন্ত।
নতুন এ আইন ঘিরে ব্যাংক খাতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আইনটি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছে ব্যাংকগুলো। তাদের আশঙ্কা, যদি আইনের অপব্যবহার হয় এবং কোনো ব্যাংকের মালিকানা জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে পুরো খাতই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। এর আগে দেশে এমন উদাহরণও রয়েছে, যেখানে মালিকানা বদল ও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন আইনের সীমা ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আইনের প্রয়োজন ছিল। তবে, এটি কার্যকর করতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।’ তার মতে, ‘আইনটি ভালোর জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে।’
অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল হয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটির অবসায়নের জন্য আদালতে আবেদন করবে। আদালত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মনোনীত কাউকে অবসায়ক নিয়োগ দেবে। অবসায়ন শুরু হলে ওই ব্যাংকের দায়ে আর সুদ বা কোনো মাশুল কার্যকর হবে না।
ব্যাংকটি চাইলে স্বেচ্ছায় অবসায়নের প্রক্রিয়ায় যেতে পারবে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে না। লাইসেন্স বাতিল হওয়ার সাত কর্মদিবসের মধ্যে আমানত পরিশোধ করতে হবে এবং অন্যান্য দায় দুই মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
যেসব ব্যক্তি বা তাদের সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংক ব্যর্থ হয় এবং ক্ষতি হয়, তারা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হবেন। অধ্যাদেশের বিধি অমান্য করলে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। তবে, প্রাথমিক খসড়ায় যেভাবে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব ছিল, তা বাদ দিয়ে প্রতিদিনের দেরির জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে বাড়তি জরিমানা যুক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘সরকার ব্যাংক খাতের প্রয়োজনে এ আইন করছে। তবে, দেখার বিষয় আইনটির প্রয়োগ কীভাবে হয়? যদি সঠিকভাবে এটি কার্যকর হয় তাহলে ব্যাংক খাতের জন্য ভালো হবে। যদি অতীতের মতো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে আইনটির অপপ্রয়োগ করা হয়, তবে তা একটি বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’
তবে, ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ নিয়ে ভয় নেই— বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘সবল ব্যাংকগুলোর জন্য কোনো সমস্যা নেই। এ আইনের অপব্যবহার যাতে না হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বদা সতর্ক থাকবে। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫ একটি সংকটময় সময়ের মধ্যে জারি করা হয়েছে। আমরা চাই, এ আইন দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি উন্নত করতে সাহায্য করবে এবং সুশৃঙ্খল ব্যাংক খাত গড়ে উঠবে। এ আইন মূলত দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য তৈরি, কিন্তু যেসব ব্যাংক ভালো অবস্থানে আছে, যাদের মুনাফা এবং সম্পদের মান ভালো এবং যারা যথাযথভাবে প্রভিশন সংরক্ষণ করছে, তাদের কোনো সমস্যা হবে না। এমনকি, এসব ব্যাংক যাতে আরও ভালোভাবে চলতে পারে, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সবধরনের সহায়তা প্রদান করবে।’
দুর্বল ব্যাংকের জন্য বিভিন্ন নিষ্পত্তির বিধান রেখে গত ১৭ এপ্রিল ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন করে উপদেষ্টা পরিষদ। গত শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এ অধ্যাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনে দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সীমাবদ্ধতা থাকায় নতুন এ আইন করার কথা বলেছে সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের আইন আছে।
দুর্বল ব্যাংক নিষ্পত্তির জন্য যে ব্যয় হবে, তা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে আলাদা তহবিল গঠিত হবে। এ তহবিলে সরকারের পাশাপাশি আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, আইডিবির মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থায়ন বা ঋণ নিতে পারবে।
ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের অধীনে দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সবধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। পুরো কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আলাদা একটি বিভাগ খুলতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারভিশন বিভাগগুলো নিয়মিতভাবে ব্যাংক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার হালনাগাদ তথ্য এ বিভাগে দেবে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা পেশ করবে ওই বিভাগ। খারাপ অবস্থায় পড়া ব্যাংকের জন্য প্রণীত আশু সংশোধনমূলক ব্যবস্থা (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় পরিকল্পনা হাতে নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে ব্যাংকের অবসায়ন সম্ভাব্যতা, আর্থিক ও পরিচালন প্রক্রিয়ার নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখাসহ বিভিন্ন বিষয় দেখতে হবে। এ ধরনের ব্যাংকের ব্যবসা বা আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিকল্পনা পরিবর্তন করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক নীতিমালা জারি করে। নীতিমালার আওতায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্যের আলোকে প্রধান কয়েকটি সূচকের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো চার ভাগে ভাগ করা হবে। যেসব ব্যাংক ক্যাটেগরি-৪ এ থাকবে, দ্রুততম সময়ে তা নতুন অধ্যাদেশের আওতায় নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে। ক্যাটেগরি-৩ এ থাকা ব্যাংকগুলোর ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।
এদিকে অধ্যাদেশ জারির আগেই, বাংলাদেশ ব্যাংক জানুয়ারিতে ছয়টি দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ মূল্যায়নের জন্য আন্তর্জাতিক অডিট ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে। এক্ষেত্রে এসআইবিএল, গ্লোবাল ইসলামী ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান যাচাইয়ে নিয়োগ পেয়েছে আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং। কেপিএমজিকে দেওয়া হয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ও এক্সিম ব্যাংকের দায়িত্ব। ব্যাংকগুলোর পরিচালকসহ সবধরনের ঋণ ও বন্ধকি সম্পত্তির মান যাচাই করা হচ্ছে। এছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পালন, ঋণবহির্ভূত ঝুঁকি, বন্ধকি সম্পত্তির বাজারদর, ঋণখেলাপি বাছাই, একক গ্রাহকের ঋণসীমা এবং পরিচালনামূলক বিভিন্ন তথ্যও যাচাই করা হচ্ছে। এর আগে, এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং আগের এমডিদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। যেসব ব্যাংক বেশি অর্থ লোপাটের শিকার হয় সেগুলো এখন বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে ২০টি ব্যাংক সম্মিলিতভাবে এক লাখ ৭১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর প্রভাবে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন করে সাতটি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়ে। এগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ও আইএফআইসি ব্যাংক। মূলধন ঘাটতিতে থাকা ছয়টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক হলো- জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল, পদ্মা, আইসিবি ইসলামী, এবি, বাংলাদেশ কমার্স ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এবং বিদেশি হাবিব ব্যাংক রয়েছে ঘাটতির তালিকায়।
এসআই/