বিএফআইইউ প্রধান শাহীনুল ইসলামের নিয়োগ বাতিল

আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ-এর প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলামের নিয়োগ বাতিল করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) জারি করা এক অফিস আদেশে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
এর আগে তার বিরুদ্ধে ওঠা ভিডিও কেলেঙ্কারি ও অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হলে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হলেও পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়।
তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বিতর্কিত ব্যবসায়ী খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ফ্রিজ করা অ্যাকাউন্ট থেকে ১৯ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ দেন শাহীনুল ইসলাম। এছাড়া তার নিজস্ব ও স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবেও অস্বাভাবিক নগদ জমার প্রমাণ মেলে। আপত্তিকর ভিডিওর ফরেনসিক পরীক্ষায়ও এর সত্যতা নিশ্চিত হয়।
গত ১৮ আগস্ট ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে উত্তেজনা দেখা দেয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিবাদের মুখে তিনি অফিস ছাড়তে বাধ্য হন এবং তদন্ত চলাকালে ছুটিতে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিনের টানাপড়েন শেষে অবশেষে নিয়োগ বাতিলের মাধ্যমে তার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।
আরও পড়ুন
পটভূমিতে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে একেএম এহসান প্রভাবশালী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন। তবে অদৃশ্য চাপের কারণে তাকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সার্চ কমিটির তালিকায় নাম না থাকা সত্ত্বেও চলতি বছরের জানুয়ারিতে শাহীনুল ইসলাম বিএফআইইউ প্রধান হন। শুরু থেকেই সেই নিয়োগ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিয়োগ বাতিলকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, গড়িমসি প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করলেও শেষ পর্যন্ত পদক্ষেপ নেওয়ায় আর্থিক খাতে আস্থা ফিরে আসবে।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শাহীনুল ইসলামের আপত্তিকর ভিডিও'র ফরেনসিক পরীক্ষায় সত্যতা মিলেছে। পাশাপাশি, ক্ষমতাসীন হাসিনা সরকারের আমলে জব্দ করা কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও নেতার ব্যাংক হিসাব থেকে অবৈধভাবে টাকা উত্তোলনে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
অনৈতিক লেনদেন
এদিকে তদন্তে উঠে এসেছে, বিতর্কিত পরিবহন ব্যবসায়ী খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার পরও সেই অ্যাকাউন্ট থেকে ১৯ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ দেন শাহীনুল ইসলাম। এ ছাড়া তার নিজস্ব ব্যাংক হিসাবেও অনিয়ম পাওয়া গেছে।
ডাচ বাংলা ব্যাংকে শাহীনুল এবং তার স্ত্রীর দুটি হিসাবের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১২ মে মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তি শাহীনুলের অ্যাকাউন্টে নগদে ২৩ লাখ টাকা জমা করেন। একই ব্যক্তি ৪ মে তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ এবং ৫ মে আরও ৫ লাখ টাকা জমা দেন।
ভিডিও কেলেঙ্কারি ও অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা
গত ১৮ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শাহীনুল ইসলামের একাধিক আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। যদিও তিনি ভিডিওগুলোকে ভুয়া দাবি করেছিলেন, ১৯ আগস্ট তিনি অফিসে অনুপস্থিত থাকেন। পরদিন অফিসে ফিরলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ গভর্নরের কাছে স্মারকলিপি দেন, যেখানে শাহীনুল রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। পরে প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে পেছনের দরজা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। পরবর্তী সময়ে সরকারের নির্দেশে তাকে অফিসে না আসার জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়। এরপর থেকে তিনি আর কর্মস্থলে ফেরেননি।
তদন্ত কমিটি ও সুপারিশ
ঘটনার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। অতিরিক্ত সচিব সাঈদ কুতুবের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটির সদস্য ছিলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম, আইসিটি বিভাগের পরিচালক মতিউর রহমান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম।
নিয়োগ ঘিরে প্রশ্ন
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের আন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন তৎকালীন বিএফআইইউ প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস। এরপর ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান একেএম এহসান। তার সময়ে শেখ হাসিনার পরিবারসহ শীর্ষ ১০টি ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো হয় এবং প্রায় দেড় হাজার ব্যাংক হিসাব জব্দ ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এই কারণে প্রভাবশালী একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তাকে স্থায়ীভাবে প্রধান হতে বাধা দেয়। অবশেষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত সার্চ কমিটির সুপারিশে নাম না থাকা সত্ত্বেও শাহীনুল ইসলাম বিএফআইইউ প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।
এসআই/এমজে