সঠিক প্রস্তুতিতে ভূমিকম্পের ক্ষতি ও প্রাণহানি কমানো সম্ভব

সময়মতো সঠিক প্রস্তুতি, জনসচেতনতা ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার (২৯ নভেম্বর) রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আবাসন খাত, স্থাপত্য, প্রকৌশল, নীতিনির্ধারণ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা– সব সেক্টরের ২০০-এর বেশি প্রতিনিধির অংশগ্রহণে ভূমিকম্প ঝুঁকি ও প্রতিরোধ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়।
সেমিনারে বক্তব্য দেন প্রকৌশলী প্রফেসর ড. এম. শামীম জেড. বসুনিয়া, প্রফেসর ড. সৈয়দ ফখরুল আমিন (বুয়েট), রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদুজ্জামান, রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম, প্রফেসর ড. রাকিব আহসান (বুয়েট) এবং বাজুস প্রেসিডেন্ট এনামুল হক খানসহ দেশি-বিদেশি বহু বিশেষজ্ঞ।
এ ছাড়া সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন জাপানের দুই ভূমিকম্প-সহনশীল স্থাপত্য বিশেষজ্ঞ– সাকো আর্কিটেক্টসের প্রতিষ্ঠাতা কেইচিরো সাকো ও ভেরিটাস জাপান এলএলসির প্রিন্সিপালহিসায়া সুগিয়ামা। তারা জাপানের ভূমিকম্প-পরবর্তী অভিজ্ঞতা, নিরাপদ অবকাঠামো নকশা ও আধুনিক টেকসই নির্মাণ মান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন।
বক্তারা বলেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনগুলোর স্ট্রাকচারাল অডিট, কাজের মান কঠোরভাবে তদারকি, জরুরি উদ্ধার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর প্রাথমিক সতর্কবার্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নাগরিকদের নিয়মিত ড্রিল, সচেতনতা কার্যক্রম এবং পরিবারভিত্তিক জরুরি প্রস্তুতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ের সমন্বিত উদ্যোগই পারে একটি ভূমিকম্প-সহনশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। সঠিক প্রস্তুতিই বড় ধরনের ধস, ক্ষতি ও প্রাণহানি কমানোর একমাত্র উপায়।
ভূমিকম্পের ক্ষতি ও প্রাণহানি কমাতে বক্তারা জরুরি করণীয় তুলে ধরেন। তারা বলেন, বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন ও অনুমোদন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন, পুরোনো ভবনের রেট্রোফিটিং, অন্তত ৫০টি নতুন আধুনিক সিসমিক স্টেশন স্থাপন, জিও ইনফরমেশন সিস্টেম ও এআইভিত্তিক ঝুঁকি মডেলিং, উদ্ধারকারী বাহিনীকে আধুনিক সরঞ্জাম প্রদান, স্কুল-কলেজ-অফিসে নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া বাধ্যতামূলক ও মাটির পরীক্ষা, মানসম্পন্ন উপকরণ ব্যবহার এবং রিয়েল এস্টেট খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। জাপান নিয়ম মেনে কাজ করে ভূমিকম্প-সহনশীল শহর গড়তে পেরেছে। বাংলাদেশও চাইলে ক্ষতি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে বলে বক্তারা একমত হন।
বক্তারা জানান, বাংলাদেশ ভারত, মিয়ানমার ও ইউরেশীয়– এই তিন সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। সিলেটের ডাউকি ফল্ট, চট্টগ্রাম-টেকনাফের চিটাগং-আরাকান ফল্ট এবং মিয়ানমারের সাগাইং ফল্ট মিলিয়ে দেশটি অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। দ্রুত নগরায়ন, ঘনবসতি, বিল্ডিং কোড উপেক্ষা এবং সংকীর্ণ সড়ক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড আয়োজিত সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো বাংলাদেশের ঝুঁকি আরও স্পষ্ট করেছে। দ্রুত নগরায়ন, ঘনবসতি এবং দুর্বল ভবন কাঠামো বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র, আবাসন খাত ও জনগণ– এই তিন স্তম্ভ শক্তিশালী হলেই ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব। সময় খুবই কম, আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জেসিএক্স ভূমিকম্প-সহনশীল স্থাপত্য নির্মাণে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
সেমিনারে উল্লেখ করা হয়, গত ১০০ বছরে বাংলাদেশে ২০০টির বেশি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে এবং ২০২৪ সালের পর থেকে কম্পনের হার আরও বেড়েছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় থাকা ‘মেগাথার্স্ট’ ফল্ট থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাবডাকশন জোনে গত ৮০০-১০০০ বছরের সঞ্চিত শক্তি এখনো মুক্ত হয়নি। যা বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে উদ্বেগজনক সতর্ক সংকেত।
আরএম/এসএসএইচ