পুনর্গঠন হবে পিপলস লিজিং

আদালতের আদেশে অবসায়ন প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (পিএলএফএস) পুনর্গঠন করা হবে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে অডিট করার প্রক্রিয়া চলছে। এসব কাজ শেষ হলে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে সব ঠিক থাকলে আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি পুনর্গঠন করা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সোমবার (১৮ জানুয়ারি) পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা জমানো অর্থ ফেরত পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে মতিঝিল শাপলা চত্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বিক্ষোভ করেন। পরে ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র আমানতকারী কাউন্সিলের আহ্বায়ক ও প্রধান সমন্বয়কারী আতিকুর রহমান আতিকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল দাবি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম এবং ব্যাংকের ডিজিএম ও পিপলস লিজিংয়ের সাময়িক অবসায়ক আসাদুজ্জামান খান।
বৈঠকে সূত্র জানায়, খুব শিগগিরই পিপলস লিজিং পুনর্গঠন (রিস্ট্রাকচারিং) করা হচ্ছে। এজন্য দুই থেকে তিন মাস সময় লাগতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় এসে চালু করতে চান আবাসন খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন রিহ্যাব সভাপতি ও শামসুল আলামিন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর শামসুল আলামিন। ইতোমধ্যে আদালতের নির্দশনায় আর্থিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে অডিটের প্রক্রিয়া চলছে। তিন থেকে পাঁচটি অডিট ফার্মের তালিকা চাওয়া হয়েছে। ওই তালিকা থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে অডিট করার অনুমতি দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অডিট শেষে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পুনর্গঠন করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীদের কয়েকজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসেছিলেন। তারা দ্রুত আমানতের টাকা ফেরত চেয়েছেন। জমানো অর্থ ফেরত চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু বিচারাধীন তাই আদালত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আদালত প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিস্থিতি জানতে অডিট করতে বলেছে। এই প্রক্রিয়া চলমান। আর পুনর্গঠনের বিষয়েও আদালত সিদ্ধান্ত নেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ে আমানতকারীদের জমা আছে দুই হাজার ৩৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ের আমানত সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের বড় অংশই নানা অনিয়মের মাধ্যমে বের হয়ে গেছে। এসব অর্থ ফেরত আসার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নানাভাবে যারা এখান থেকে অর্থ নিয়েছেন তাদের অনেকেই এখন পলাতক। ফলে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যে কারণে এখন প্রতিষ্ঠানটি চালুর মাধ্যমে অর্থ ফেরতের বিকল্প ভাবা হচ্ছে।
এদিকে সোমবার পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা তাদের টাকা ফেরত পেতে ১৫ দিনের আলটিমেটাম দেয়।
মানববন্ধনের আহ্বায়ক ও প্রধান সমন্বয়কারী আতিকুর রহমান আতিক বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালকের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। কিছু ব্যক্তি মাসের পর মাস এই ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে শত শত কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করলেন, অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলোর কোনো খবর রাখেনি। যখনই পাচারকারীরা দেশ ছেড়ে চলে গেলেন তখনই এই টাকার সন্ধান করা হয়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগসাজশে টাকা পাচার হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকার পরও কীভাবে এখান থেকে টাকা পাচার হয়? ব্যাংকের অডিটের সময় কেন ধরা পড়ে না? আমরা আজ কোনো ভিক্ষা চাচ্ছি না, প্রণোদনাও চাচ্ছি না, আমরা আমাদের টাকা ফেরত চাচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের বারবার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত টাকা ফেরত দেয়নি।’
তিনি আলটিমেটাম দিয়ে বলেন, ‘আগামী ১৫ দিনের মধ্যে যদি আমাদের টাকা ফেরত না পাই তাহলে রাজপথে অবস্থান করব। প্রতিটি ফাইন্যান্স কোম্পানির সামনে আমরা ব্যানার টানিয়ে দেব। তাতে লিখা থাকবে- ফাইন্যান্স কোম্পানিতে টাকা দিলে আপনি এক টাকাও ফেরত পাবেন না।
আতিক বলেন, পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে আমাদের টানা অবস্থান কর্মসূচি চলবে। অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। আর পারছি না, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমাদের অনেকে অসুস্থ, কেউ কেউ মারা গেছেন। অনেকেই চিকিৎসা করাতে পারছেন না। মেয়ে বিয়ে দিতে পারছেন না। সংসার চালাতে পারছেন না। আমাদের টাকা ফেরত দিন। আমরা বাঁচতে চাই।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ে আমানতকারীদের জমা আছে দুই হাজার ৩৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ের আমানত সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের বড় অংশই নানা অনিয়মের মাধ্যমে বের হয়ে গেছে। এসব অর্থ ফেরত আসার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নানাভাবে যারা এখান থেকে অর্থ নিয়েছেন তাদের অনেকেই এখন পলাতক। ফলে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যে কারণে এখন প্রতিষ্ঠানটি চালুর মাধ্যমে অর্থ ফেরতের বিকল্প ভাবা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে পিপলস লিজিং থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণের অর্থ বের করে নেওয়ার ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়। বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ধুঁকতে থাকা পিপলস লিজিং ২০১৯ সালের জুলাই থেকে আদালতের নির্দেশে অবসায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর আগে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৫ সালে পাঁচ পরিচালককে অপসারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর অপসারণের আগেই তখন পিপলস লিজিং থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন তৎকালীন চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন জানায়, দেশ থেকে পলাতক প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে পিপলস লিজিংয়ে আমানতকারীদের ৩ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাৎ করেন।
এর আগে, ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার পর ২০০৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ছিল। ২০১৯ সালে ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে পিপলসের অবসায়নের আবেদন করে। গত ২৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় সে আবেদন অনুমোদন করলে ১০ জুলাই পিপলসের অবসানের বিষয়টি অনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। একই বছরের ১১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং থেকে টাকা তোলার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করে। ১৪ জুলাই বাংলাদেক ব্যাংকের ডিজিএম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানকে প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়।
এসআই/ওএফ