সোনালী ব্যাংকের এক শাখায় ঋণের ৭২ শতাংশই খেলাপি

Md Shofiqul Islam

১৬ নভেম্বর ২০২১, ০৯:১৭ এএম


সোনালী ব্যাংকের এক শাখায় ঋণের ৭২ শতাংশই খেলাপি

• ৩৫ শতাংশ ঋণই মন্দ মানের তালিকায় আরও তিন শাখায় 
• শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকায় রয়েছে ফেয়ার ট্রেড ফেব্রিক্স, ফেয়ার এক্সপো ও সুমি’স সোয়েটার
• বন্ধকি জমিগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে
• খেলাপিরা বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে রাখে
• মূলধন ঘাটতি পূরণে ১০ হাজার কোটি টাকা চায় ব্যাংকটি  

নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর রাজনৈতিক প্রভাবে যাচাই-বাছাই ছাড়াই দেওয়া হয়েছে ঋণ। এখন আদায় হচ্ছে না। ফলে বেকায়দায় পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের রমনা কর্পোরেট শাখা। 

এ শাখা থেকে বিতরণ করা ঋণের ৭২ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। একইভাবে চলছে ব্যাংকটির আরও তিনটি শাখা। যাদের ৩৫ শতাংশ ঋণই মন্দ মানের তালিকায় রয়েছে। শাখাগুলো হলো- ঢাকা-১ জিএম অফিস, জিএম অফিস খুলনা ও চট্টগ্রাম। এসব শাখায় বড় ঋণ কেলেঙ্কারিসহ জাল-জালিয়াতি এবং আত্মসাতের ঘটনাও ঘটছে। এসব কারণেই সংকটে পড়েছে জনগণের মালিকানায় থাকা দেশের সবচেয়ে বড় এ ব্যাংকটি। 

সোনালী ব্যাংকের অন্যতম শাখা রাজধানীর রমনা কর্পোরেট শাখা। ব্যাংকের এই শাখা থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ৯২৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে মন্দ বা খেলাপি হয়ে পড়েছে ৬৬৯ কোটি ৬৬ লাখ; যা মোট ঋণের ৭২ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শাখাটি খেলাপি ঋণ আদায় করেছে মাত্র ৪৭ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ঋণ আদায় করেছে মাত্র দুই কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাখাটির অন্যতম খেলাপির তালিকায় রয়েছে মেসার্স ফেয়ার ট্রেড ফেব্রিক্স, মেসার্স ফেয়ার এক্সপো এবং মেসার্স সুমি’স সোয়েটার লিমিটেড। এসব কোম্পানির নাম সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকায় রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের রমনা কর্পোরেট শাখার জেনারেল ম্যানেজার নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা খেলাপি ঋণ আদায়ে কাজ করছি। চলতি বছরে ১৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা আদায় করেছি। আমাদের একটি টিম এর জন্য কাজ করছে। 

তিনি বলেন, কিছু গ্রাহকের মনোভাবই এমন যে সরকারি ব্যাংকের টাকা আর ফেরত দিতে হবে না। আমরা খেলাপি গ্রাহকদের ডেকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি। ঋণগুলো অনেক আগের। অনেক গ্রাহক মারা গেছেন। আমাদের এ শাখায় অনেক দিন ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। তাই খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। এখন এ শাখায় ৭০ শতাংশের ওপরে খেলাপি ঋণ। বেশিরভাগের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। অনেকের বন্ধকি জমি আমরা বুঝে পেয়েছি। এগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছি। এখান থেকেই অনেক ঋণ আদায় হবে। 

শাখাটির জিএম আরও জানান, বর্তমানে ব্যাংকের পর্ষদ খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিয়েছে। ব্যাংকের এমডি সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। খেলাপি আদায়ে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। আগামীতে ঋণ আদায় বাড়বে, খেলাপির পরিমাণও কমে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। 

সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণে জর্জরিত আরেক শাখা ঢাকা-১ জিএম অফিস। শাখাটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ চার হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। খেলাপির এ অংক মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের খেলাপি ঋণ আদায়ের পরিমাণ ৭৭ কোটি টাকা। এ বছর আগস্ট পর্যন্ত আদায় ৩৭ কোটি টাকা। 

শুধু ঢাকা নয় খুলনা জিএম অফিসের খেলাপির হার ৩৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এই শাখা থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত শাখাটির খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে ১৫৪ কোটি টাকা। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত তাদের খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে ৯৭ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণে চাপে থাকা আরেক শাখা চট্টগ্রাম জিএম অফিস। এ শাখায় ঋণের পরিমাণ তিন হাজার ২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ১৩৬ কোটি টাকাই খেলাপি হয়েছে; যা মোট ঋণের ৩৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে তাদের খেলাপি ঋণ আদায়ের পরিমাণ ৫৮ কোটি টাকা। এছাড়া এবছরের আগস্ট পর্যন্ত আদায় করেছে ২০ কোটি টাকা।

ঋণ খেলাপি ও দুর্নীতিতে আলোচনায় আসা ব্যাংকটির অন্য শাখাগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্থানীয় কার্যালয়, হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে আলোচিত হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল করপোরেট শাখা, দিলকুশা করপোরেট, লালদীঘি শাখা, নারায়ণগঞ্জ করপোরেট, দৌলতপুর করপোরেট, খুলনা করপোরেট, আগ্রাবাদ করপোরেট ও ফরিদপুর করপোরেট শাখা।

তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির সবাই এই শাখাগুলোর গ্রাহক, যাদের সমন্বিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার হাজার ৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের মোট খেলাপির ৩৮ শতাংশ মাত্র ১০টি শাখার ‘অবদান’।

সোনালী ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের আগস্ট শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৭২১ কোটি ১৩ লাখ টাকা; যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই পাওনা চার হাজার ৮৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

সোনালী ব্যাংকের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ বড় খেলাপি ঋণ আদায়ে আদালতে মামলা করা হয়েছে। তবে একদিকে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা, অন্যদিকে খেলাপিরা বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে রাখে। ফলে ইচ্ছা থাকার পরও খেলাপি ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শুধু সোনালী নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চলছে। এখানে প্রভাবশালীদের চাপ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ঋণ কেলেঙ্কারি হচ্ছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব অনিয়মে সহযোগিতা করছেন। সুশাসনের অভাব রয়েছে, তেমন জবাবদিহিও করতে হয় না। প্রভাবশালীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না, আবার বিভিন্ন চাপে ব্যাংকের কিছু করারও থাকে না। 

যে কোনো উপায়ে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে বলে পরামর্শ দিয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চাপ দিতে হবে। পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা লাগবে। একই সঙ্গে সুশাসন নিশ্চিত ও পর্ষদকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, মূলধন সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম সোনালী ব্যাংক। ২০২১ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৫৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়লে জাতীয় বাজেট থেকে তার যোগান দিতে হয়। জনগণের করের টাকায় বিভিন্ন সময় মূলধন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকগুলোতে অর্থ যোগান দিয়ে আসছে সরকার। তবে করের টাকায় মূলধন যোগানের বরাবরই বিরোধিতা করে থাকেন অর্থনীতিবিদরা। এ কারণে গত কয়েক বছর ধরে এ অর্থ দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।

এরপরও মূলধন ঘাটতি পূরণে ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারের কাছে চেয়েছে সোনালী ব্যাংক। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মূলধন ঘাটতি পূরণে বাজেট থেকে নগদ অর্থ না নিয়ে নগদ সহায়তার বিপরীতে সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যু বা সরকারি গ্যারান্টিপত্র অথবা নামমাত্র সুদে পারপেচুয়াল বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না।

এসআই/এনএফ/জেএস

Link copied