রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সায়
নিয়ন্ত্রণের বাইরে খেলাপি ঋণ

ব্যাংক ঋণ দেওয়ার একটা সীমা আছে। সে সীমা অতিক্রম করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকও সে ঋণে সায় দিচ্ছে। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েও অনেকে ঋণ নেন। ফলে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এভাবে বেআইনিভাবে ঋণ দেওয়া-নেওয়া বেড়ে যাওয়ায় আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে মনে করেন দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শীর্ষ ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার (২৯ ডিসেম্বর) হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দ্বিতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২১-এ বক্তারা এসব কথা বলেন।
বণিক বার্তার আয়োজনে অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ফজলে কবির। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ড. আতিউর রহমান, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আতাউর রহমান প্রধান এবং ইসলামী ব্যাংকের এমডি ও সিইও মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা।
তবে সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি অংশগ্রহণ করেননি।
সিটি ব্যাংকের এমডি ও সিইও মাসরুর আরেফিন স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে সম্মেলনটি শুরু হয়। সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ঋণ ফেরত না পেলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আবার যারা ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই। তবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশংসা করেন তিনি।
তদন্ত প্রতিবেদন ড্রয়ারে গেলে দুর্নীতির প্রবাহ শুরু হবে মন্তব্য করে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, যখন কোনো নালিশ আসবে, তখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর্থিক দুর্নীতি বা যেকোনো তদন্ত প্রতিবেদন ড্রয়ারে যায় তখনই দুর্নীতির প্রবাহ শুরু হয়। তাই এখন সময় এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার।
তিনি বলেন, ব্যাংকের শাখায় আইনজীবী নিয়োগ দেয়। কিন্তু দেখা যায় ওইসব আইনজীবীরা ব্যাংকের টাকা নিয়ে খেলাপির পক্ষে কাজ করে, এটি বন্ধ করতে হবে। রেমিট্যান্স-রফতানি ওপর বর্তমানে যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে এসব প্রণোদনা অর্থনীতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এমন কোনো নজির নেই। তাই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে এসব প্রণোদনা আস্তে আস্তে উঠিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ৮০-র দশকে যখন বেসরকারি ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল তখন আমরা জানতাম না তাদের জন্য আলাদা নীতিমালা দরকার হবে। পরে আমাদের আইন ও নীতিমালা করতে হয়েছে। এখন একজন ব্যক্তির হাতে একাধিক ব্যাংক চলে গেলে রেগুলেশন কী হবে তা এখনো শিখিনি। এটিও শিখতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে প্রধান হিসেবে যাদের বসানো হয় তারা অনেকেই যোগ্য নয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে এখন পর্যন্ত যারাই এসেছেন তারা সবাই যোগ্যতাসম্পন্ন।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমদ বলেন, আমাদের আইনকানুন আন্তর্জাতিক মানের। তবে, সমস্যা বাস্তবায়নে। এজন্য অনিয়ম কমাতে আইনের বাস্তবায়ন জরুরি। অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর তদারকির জন্য আলাদা আলাদা সংস্থা থাকে। কিন্তু দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একাই এসব তদারকি করছে। একক সংস্থা হিসেবে এতোগুলো কাজ করা খুবই কঠিন বিষয়। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক কাজগুলো ভালোভাবেই করছে।
রেমিট্যান্সে প্রণোদনা বাড়ানোর সুপারিশ সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, করোনার কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সবচেয়ে বড় যে তিনটি খাত ভূমিকা রেখেছে তার মধ্যে রেমিট্যান্স অন্যতম। যে কারণে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা আরও এক শতাংশ বাড়ানো উচিত।
প্রবাসী বন্ড কেনায় এক কোটি টাকার যে সীমা নির্ধারণ করা আছে সেটাকে তুলে নেওয়ার সুপারিশ করে আতিউর রহমান বলেন, প্রয়োজনে এক কোটি টাকার ওপরে বন্ডের বিনিয়োগের সুদহার কমানো যেতে পারে। তারপরও এক কোটি টাকার সিলিং উঠিয়ে নেওয়া উচিত।
দেশের অর্থনীতিতে বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে মন্তব্য করেন আতিউর রহমান বলেন, করোনাকালে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি যখন ধসে গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি তখনও দাঁড়িয়েছিল। এছাড়া করোনার ফলে আমাদের আমদানি বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। আশার কথা হলো, এর বেশিরভাগই কাঁচামাল। ফলে এটা শিল্পের জন্য সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
২০৩৫ সালেই শীর্ষ ২৫তম অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ ৪১তম বড় অর্থনীতির দেশ। তবে আগামী ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। সামনের দিনে দেশের অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে করোনাজনিত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংক নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন করে দারিদ্রসীমায় প্রবেশের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি তেমন একটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েনি। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা রাখতে এবং করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও গতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাঝে সমন্বয়ের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করে অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, বিশ্বের শীর্ষ ৪১টি শীর্ষ অর্থনীতি দেশের মধ্যে মাত্র আটটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল গত অর্থ বছরে। তার মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। এটি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যথাযথ যোগসূত্র থাকার কারণে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো ফাইনান্স ও মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রাখা। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। শেষ ১০ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবদান হল অটোমেশন। একসময় সরকারিভাবে ১০০ টাকা বিতরণ করতে গেলে ২৫ টাকা খরচ করতে হতো। এখন তা হচ্ছে না।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে বলেও জানান আব্দুর রউফ তালুকদার।
সম্মেলনের আলোচনায় অংশ নিয়ে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, একক গ্রাহকের ব্যাংক ঋণ নীতিমালা আছে। এই নীতিমালার অতিরিক্ত ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রস্তাব যায় এবং সেটি ঠিকই অনুমোদন হয়ে যায়। এটা বন্ধ করা গেলে খেলাপি ঋণ কমবে। সুদের হারও আরও কমানো যাবে। ব্যাংকগুলোকে অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ দিতে হয়। খেলাপি ঋণ সব চেয়ে বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে।
তার মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংককে একীভূত করে এক ব্যাংকে রূপান্তরিত করলে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে যদি অনেক বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়া যায় তাহলে আরও কর্মসংস্থান হবে, অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋণে এখনো অনেক হয়রানি হয় বলে মন্তব্য করে- তা বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে নজর দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান বলেন, একজন গ্রাহকের ১১টি ঋণ আছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে নিয়েছেন একটি ঋণ। আর ১০টি ঋণ নিয়েছেন বেসরকারি ব্যাংক থেকে। মজার বিষয় হলো- বেসরকারি ১০টি ঋণ তার নিয়মিত। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের ঋণটি তার শতভাগ খেলাপি। এখন চাপ দিচ্ছেন পুনঃতফসিল করার জন্য। এবার বলেন- সরকারি ব্যাংকের কী করণীয়।
এসআই/ওএফ