গৃহবধূ থেকে ব্রোকারেজ হাউসের মালিক

খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন মুন্নি : ছয় বছর ছিলেন গৃহবধূ, এরপর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, তার পরের ছয় বছরে তিনি হয়েছেন একটি ব্রোকারেজ হাউসের মালিক
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন মুন্নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন বারডেমে। কিন্তু পারিবারিক কারণে বেশি দিন করা হয়নি এ চাকরি। টানা ছয় বছর সংসার করে ১৯৯৯ সালে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগকারী থেকে হয়ে যান ব্রোকারেজ হাউসের মালিক। চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা বনে যাওয়া এ নারী কর্মসংস্থান করেছেন আরও শতাধিক মানুষের।
মডার্ন সিকিউরিটিজ লিমিটেডের সিইওর পাশাপাশি এখন অনলাইন নিউজ পোটাল পূর্বপশ্চিম বিডিরও সম্পাদক তিনি। উদ্যোক্তা মুন্নী এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগের উপকমিটির সদস্য। তিনি সম্প্রতি মোহামেডান ক্লাবে পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইর) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নারী দিবস উপলেক্ষে আজ ঢাকা পোস্টে থাকছে তার বিশেষ সাক্ষাৎকার।
ঢাকা পোস্ট: কেমন আছেন?
মুন্নী: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।
ঢাকা পোস্ট: পড়াশোনা শেষ করে বারডেমে গবেষক হিসেবে কিছু দিন কাজ করলেন। তারপর দীর্ঘ বিরতির পর স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ, সেখান থেকে সফল উদ্যোক্তা আপনি। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন কি আগে থেকেই ছিল?
মুন্নী: আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম, ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার, হয়েছি স্টক ব্রোকার। শিক্ষক হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াতাম আর এখানে বিনিয়োগকারীদের বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছি, বিনিয়োগ শিক্ষা দিচ্ছি। আমি মনে করি, প্রত্যেক মানুষই ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে। শিক্ষকতা আমার ভাগ্যে ছিল না। তাই হয়নি, তবে ব্রোকার হয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি।
ঢাকা পোস্ট: নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?
মুন্নী: ব্রোকার হতে এসে প্রতিনিয়তই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বাধা পেরোতে হচ্ছে। নিজেকে যখনই পুরুষের সমকক্ষ মনে করি তখনই পুরুষতান্ত্রিকতার বাধার মুখে পড়ি। বাধা কখনো কথা দিয়ে হয়েছে, আবার কাজ দিয়েও হয়েছে। এই সমাজ নারীদের ততক্ষণ পর্যন্ত সম্মান করে যতক্ষণ পর্যন্ত নারী মা-বোন, মেয়ে এবং স্ত্রী হয়ে থাকে। যখনই পুরুষের সমান হতে চায় তখনই বলে তুমি তো মেয়ে, সেই জায়গাই থাকো। পুরুষের সঙ্গে কথা, কাজ, আচার-আচরণসহ সবকিছু দিয়ে লড়াই করতে হয়। এখনো করছি, জানি না এই লড়াই কতদিন করতে হবে। এটা শুধু আমার ব্যাপারেই নয়, যে নারীই পুরুষের সঙ্গে কাজ করছে, তারাই এই বাধার মুখে পড়ছে।
ঢাকা পোস্ট: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের শুরুর গল্পটা শুনতে চাই…
মুন্নী: ১৯৯৬ সালের শেয়ার বাজারের ধসে আমার স্বামীর অনেক ক্ষতি হয়। ভীষণ সংকটের মধ্যে ছিল আমাদের পরিবার। তখনই আমার কৌতূহল জাগে পুঁজিবাজার কি এমন জায়গায় থাকবে যাতে লোকসান হয় মানুষের। মার্কেট বুঝার জন্য ১৯৯৯ সালে মাত্র ৫০ হাজার টাকা আইপিওতে বিনিয়োগ করি। এরপর পর্যায়ক্রমে সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগ করি। ধীরে ধীরে লাভের মুখও দেখছিলাম। এরপর ২০০৫ সালে স্টক ডিলার সদস্য ছাড়া হলে তখন আমি কিনে ফেলি। ওই সময় আমার কাছে এত টাকা ছিল না। আমার বাবা এবং স্বামী আমাকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন।

ঢাকা পোস্ট: পুঁজিবাজারে নারীর অংশগ্রহণ এখনো উল্লেখ করার মতো হয়নি। এর পেছনের কারণ কী?
মুন্নী: মেয়েরা কাজ করতে চায় না, তাদের কনফিডেন্স নেই। কাজ করে খাবে তার চেয়ে বেশি চায় বড় লোক একটা স্বামী হোক, আরাম-আয়েশে থাকি, সমাজে এ ধরনের কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের দ্বিগুণ কাজ করতে হয়। প্রথমে বাচ্চা-কাচ্চাসহ ঘরের কাজ করতে হয়। এরপর অফিসের কাজও করতে হয়। সব মেয়ের পক্ষে দুই জায়গায় সমানভাবে কাজ করা সম্ভব হয় না। এছাড়া দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মেয়েরা এগিয়ে যেতে পারে না। একটি মেয়ে যখন বাপের বাড়ি থাকে তখন তাকে তার মতো করে চলতে দেয়, কিন্তু একই মেয়ে যখন পরিবারে বউ হয়ে যায় তখন সবার মন জয় করতে হয়।
ঢাকা পোস্ট: পরিবার ও অফিস সমানতালে সামলাতে হয় আপনাকে। এত ব্যস্ততার মধ্যে কী নিজের শখ পূরণ করতে পারেন?
মুন্নী: আমার দুটি শখ ছিল, সময় পেলেই খেলতাম, আর বই পড়তাম। আমি অনেক পড়াশোনা করতাম। যা হাতের কাছে পেতাম তাই পড়তাম। বই পড়ার জন্য জীবনে অনেক মারও খেয়েছি। পরিবারই হলো মেয়েদের প্রথম অনুপ্রেরণার জায়গা। আমরা তিন ভাই এক বোন ছিলাম। ভাইদের চেয়ে আমাকে পড়াশোনা, খেলাধুলায় আগ্রহ বেশি দেখিয়েছেন আমার বাবা-মা। পরিবারই আমার দিগন্ত খুলে দিয়েছে। পরিবার আমাকে নারী-পুরুষের তফাৎ করেনি, বুঝতেও দেয়নি।
ঢাকা পোস্ট: তাহলে নারীদের বাধা কোথায়?
মুন্নী: নারীর বাধাটা হচ্ছে মানসিকতায়, আর কিছুই না। তবে পারিবারিক ও সামাজিক কিছু বাধা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সমাজে নারীদের যে পরিমাণে সুরক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, সেই পরিমাণ সুরক্ষা দিতে পারছে না। আমরা আগে অনেক সুরক্ষিত ছিলাম, ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করেছি। বাবা-মার কোনো চিন্তা ছিল না। কিন্তু আমার মেয়ে এখন ঠিকমতো বাড়ি ফিরতে পারবে কি না সে চিন্তায় সবসময় থাকি। এজন্য অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তাহলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।
ঢাকা পোস্ট: আপনাকে ধন্যবাদ
মুন্নী: ঢাকা পোস্টকে ধন্যবাদ।
এমআই/এসকেডি/এমএমজে