পুঁজিবাজার থেকে সরকার রাজস্ব হারাল দ্বিগুণ

Mahfuzul Islam

০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৩৫ পিএম


পুঁজিবাজার থেকে সরকার রাজস্ব হারাল দ্বিগুণ

১১ কর্মদিবস পতন আর ১২ কর্মদিবস উত্থানের মধ্যদিয়ে নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারি পার করল দেশের পুঁজিবাজার। ভয় ও আতঙ্কের এই মাসে বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রি থেকে কর বাবদ সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ১৭ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সরকার রাজস্ব হারিয়েছে দ্বিগুণের বেশি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ডিএসইর তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডিএসইতে মোট ২৩ কর্মদিবসে ১১ হাজার ৭২৬ কোটি ৮৪ লাখ ১৪ হাজার ৩২৭ টাকার শেয়ার ও মিউচ্যুায়ল ফান্ডের ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। সেখান থেকে লেনদেনের ওপর কমিশন বাবদ সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ১৭ কোটি ৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৫৬ টাকা।

এর আগের বছর ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে লেনদেন হয়েছিল ৩১ হাজার ২৬১ কোটি ২১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৩৫ টাকা। সেখান থেকে রাজস্ব আয় হয়েছিল ৩৯ কোটি ৭০ লাখ ৭ হাজার ৩৮ টাকা।

অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ২২ কোটি ৬৫ লাখ ৯১ হাজার ৮২ টাকা। যা আড়াই গুণের চেয়েও বেশি।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গেল জানুয়ারি মাসে এর আগের বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় পুঁজিবাজারে শেয়ার কেনা-বেচা কম হয়েছে। শেয়ার কেনা-বেচা কমায় ডিএসইতে লেনদেনও কম হয়েছে। এ কারণে সরকার এ খাত থেকে রাজস্বও কম পেয়েছে।

তারা বলছেন, লেনদেন কমার পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। একটি কারণ হচ্ছে- দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইস আরোপ থাকায়। ফ্লোর প্রাইসের ফলে দুই শতাধিক কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে না।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অধিকাংশ কোম্পানির মুনাফা কমেছে। কিছু কিছু কোম্পানি লোকসানেও পড়েছে। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বেড়েছে। যারা সঞ্চয় হিসেবে শেয়ার কিনে রেখেছিল এখন শেয়ার বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে সংসারে ব্যয় মেটাচ্ছে। এসব কারণে শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রির প্রবণতা বেশি ছিল। তবে বিক্রেতার হিড়িক থাকার পরও ক্রেতার সংকটের কারণে লেনদেন কমেছে।

ফলে সরকার ডিএসই থেকে কর বাবদ রাজস্ব কম পেয়েছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, বাজার স্থিতিশীল হলে লেনদেন বাড়বে, তখন সরকার আরও বেশি কর পাবে।

আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, দুই ধরনের শেয়ার কেনা-বেচা থেকে সরকার রাজস্ব আয় করে। প্রথমটি হলো- কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার কেনা-বেচা থেকে রাজস্ব আয়। দ্বিতীয়টি হলো- বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনা-বেচায় ব্রোকারেজ হাউজের ওপর আরোপিত কর।

ডিএসইর তথ্য মতে, দুই ধরনের করের মধ্যে প্রথমটি হলো- ডিএসইর স্টেক হোল্ডারদের দৈনিক লেনদেনের ওপর দশমিক ০৫ শতাংশ কর। এ খাত থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রাজস্ব আয় হয় মাত্র ১১ কোটি ৮০ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬৩ টাকা।

অন্যদিকে, বিএসইসি রুলস ৫৩-এম অনুসারে, স্পন্সর শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার কেনা-বেচা বাবদ লেনদেন ও শেয়ার হস্তান্তর থেকে ৫ শতাংশ হারে কর বাবদ রাজস্ব আয় হয়েছে ৫ কোটি ২৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৯৩ টাকা।

সব মিলিয়ে ডিএসই থেকে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ১৭ কোটি ৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৫৬ টাকা। ডিএসই এ টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জমা দিয়েছে।

এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে জমা দিয়েছিল ৩৯ কোটি ৭০ লাখ ৭ হাজার ৩৮ টাকা। সে হিসেবে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ২২ কোটি ৬৫ লাখ ৯১ হাজার ৮২ টাকা। যা প্রায় আড়াই গুণ।

উল্লেখ্য, এর আগে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০২২ সালে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছিল দুই লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৭ কোটি ৯৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার শেয়ার, বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট। সেখান থেকে কর বাবদ সরকারে রাজস্ব আয় হয়েছিল ৩১৯ কোটি ১০ লাখ ৩১ হাজার ৫৩ টাকা।

তার আগে ২০২১ সালে ডিএসইতে লেনদেন হয় ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৯৭৮ কোটি ৬১ লাখ ৯০ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট। সেখান থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছিল ৪২৫ কোটি ৮৬ হাজার ৯২০ টাকা। অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সরকার পুঁজিবাজার থেকে ১০৫ কোটি ৯০ লাখ টাকার রাজস্ব কম পেয়েছে।

সরকারকে রাজস্ব কম দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সাইফুর রহমান মজুমদার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, লেনদেন কম হওয়ায় সরকার পুঁজিবাজার থেকে রাজস্ব আয় কম পেয়েছে। পুঁজিবাজারে যত লেনদেন বেশি হবে সরকার এ খাত থেকে রাজস্ব আয়ও বেশি পাবে। ডলারের তুলনায় টাকার মান কমেছে। এছাড়াও বিশ্বমন্দা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক অর্থনীতি টানাপড়েনের মধ্যে দিন পার করছে, যার প্রভাব দেশের পুঁজিবাজারে পড়েছে। এ কারণে লেনদেন কম হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ঠিক থাকলে পুঁজিবাজার ভালো হবে। বাজার ভালো থাকলে সরকারও এ খাত থেকে রাজস্ব বেশি পাবে। বাজারে লেনদেন বৃদ্ধির জন্য অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড চালু করা হয়েছে, বন্ড মার্কেটের জন্য স্বতন্ত্র অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রতিষ্ঠাসহ বাজারের অধিকতর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গুণগতমান বাড়ানোর জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। আশা করি, পুঁজিবাজারে এর সুফল বয়ে আনবে, বাড়বে লেনদেন।

ডিএসইর পরিচালক শরীফ আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজার ভালো হলে সরকারও পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে আরও বেশি রাজস্ব পাবে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও ঢাকা পোস্টকে বলেন, লেনদেন বাড়াতে হলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিতে হবে। ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে শেয়ার কেনা-বেচা বাড়বে। সরকারও এ খাত থেকে রাজস্ব পাবে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে কাজ করছি। আশা করছি পুঁজিবাজার আরও বেশি গতিশীল হবে। সরকার এবং সাধারণ মানুষও এইখান থেকে মুনাফা নিতে পারবে।

এমআই/এফকে

Link copied