শিক্ষার্থী নির্যাতনে ইমেজ সংকটে চট্টগ্রামের মাদরাসা শিক্ষা

Dhaka Post Desk

কাজী মনজুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম

১৩ মার্চ ২০২১, ০৮:৪৮ পিএম


শিক্ষার্থী নির্যাতনে ইমেজ সংকটে চট্টগ্রামের মাদরাসা শিক্ষা

চট্টগ্রামের বিভিন্ন মাদরাসায় নিয়মিত বিরতিতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে। এতে ইমেজ সংকটে পড়েছে চট্টগ্রামের মাদরাসা শিক্ষা। তবে এসব ঘটনার জন্য প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তি শিক্ষককেই দায়ী করছেন মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা। এদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রশাসনের নজরদারির অভাবেই মাদরাসায় এমন ঘটনা বাড়ছে। তাদের দাবি, মাদরাসাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকুক।  

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মাদরাসাগুলাতে সরকারের মনিটরিংয়ের অভাব আছে। রাষ্ট্রের দায়িত্বে যারা আছেন, এসব বিষয়ে তাদের আরও সংবেদনশীল হওয়া দরকার।’

মাদরাসাগুলোকে শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারায় এনে মনিটরিং করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

সুজন চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত মাদরাসাগুলোকে শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারায় আনা। মাদরাসাশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ইনস্টিটিউশন খোলা। বাচ্চাদের কীভাবে পড়াবে, কেমন আচরণ করবে তার প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। যেভাবেই হোক, শিশু নির্যাতন থেকে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে।’

আখতার কবির আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, মাদরাসায় শিক্ষক হতে হলে যে মিনিমাম যোগ্যতা দরকার তা ঠিক করে দেওয়া। শারীরিক নির্যাতন করা একটা অপরাধ- এটা ব্যাপকভাবে শিক্ষকদের মধ্যে প্রচার করতে হবে।’ 

Dhaka Post

আখতার কবির বলেন,‌‌ ‍‘কওমি মাদরাসার শিক্ষকরা পাঠদানের প্রশিক্ষণ পান না। ফলে অনেকেই শিশুকে ভয়ভীতি দেখিয়ে শেখাতে চান। খোঁজ নিলে দেখবেন, যেসব শিক্ষক ভয়ভীতি দেখিয়ে শেখাতে চান বা শিশু নির্যাতন করেন, তারাও ছাত্রজীবনে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফলে এটাকে তারা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখেন।’

নির্যাতন শিশুদের মানসিকভাবে হত্যা করে। নির্যাতনকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন।

মাদরাসায় শিক্ষার্থী নির্যাতনের প্রভাব সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নির্যাতন শিশুদের মানসিকভাবে হত্যা করে। এতে পড়ালেখার প্রতি ভীতি সৃষ্টি হয়। লেখাপড়া হচ্ছে আনন্দের বিষয়। বাচ্চাদের পড়াতে হবে আনন্দ দেওয়ার মাধ্যমে। নির্যাতনকারী শিক্ষকদের অবশ্যই এ পেশা থেকে বাদ দিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নির্যাতন কাম্য নয়। মাদরাসাসহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে  নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।’ 

Dhaka Post

তিনি আরও বলেন, ‘মাদরাসার শিক্ষার্থীরা যেন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে সেদিক নজর দিতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্লেষণাত্মক, যুক্তিনির্ভর চিন্তাচর্চাকে প্রাধান্য দিয়ে পাঠদান করা হলে যেখানে যতটুকু অন্ধকার আছে, কেটে যাবে।’ 

পাঠদান সম্পর্কে কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের ধ্যানধারণা পুরনো উল্লেখ করে চট্টগ্রামের বখতিয়ারপাড়া চার পীর আউলিয়া আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ কাজী মো. আবদুল হান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে কওমি এবং হাফেজিয়া মাদরাসা। আলীয়া মাদরাসার মতো এসব মাদরাসা কিন্তু সরকার নিয়ন্ত্রিত নয়। এসব মাদারাসার শিক্ষকদের বর্তমান যুগের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তারা অনেকটাই পশ্চাৎপদ।’

মাদারাসার শিক্ষকরা অনেকটাই পশ্চাৎপদ।

অধ্যক্ষ কাজী মো. আবদুল হান্নান।

তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থী নির্যাতনের সব ঘটনা কিন্তু সামনে আসে না। কিছু ঘটনা সামনে আসে, ভাইরাল হয়। সরকারের এ ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। শিক্ষার নামে নির্যাতন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না।’ 

তবে শিক্ষার্থী নির্যাতনের দায় মাদরাসার নয়, শিক্ষকের বলে মনে করেন হাটহাজারী উপজেলার আলহুদা মাদরাসার পরিচালক মাওলানা মীর ইদ্রিস। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘কওমি মাদরাসা তো নির্যাতনের পক্ষে নয়। ছাত্রনির্যাতন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শিক্ষকরা যাতে নির্যাতন না করেন সেজন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কীভাবে পড়াতে হয় শিক্ষকদের সে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কওমি মাদরাসাগুলোর শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)।’

কওমি মাদরাসায় নির্যাতন নিষিদ্ধ। কীভাবে পড়াতে হয় শিক্ষকদের সে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বেফাক।

আলহুদা মাদরাসার পরিচালক মাওলানা মীর ইদ্রিস।

বলাৎকারসহ মাদরাসায় নির্যাতনের অনেক অভিযোগই মিথ্যে প্রমাণিত হয় দাবি করে তিনি আরও বলেন, ‘অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও কিন্তু অনেক বড় বড় অপরাধ হয়। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় মানুষের দৃষ্টি মাদরাসার দিকে বেশি থাকে। তবে নির্যাতনের ঘটনা যেখানেই ঘটুক তা নিন্দাযোগ্য।’

Dhaka Post

সম্প্রতি চট্টগ্রামে শিশু শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে কারাগারে গেছেন এক মাদরাসাশিক্ষক। মায়ের সঙ্গে বাড়ি যেতে চাওয়ার ‘অপরাধে’ পেটানো হয় হাটহাজারী উপজেলার মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমির হিফজ বিভাগের মাদরাসার ওই শিশুকে। এর কয়েকদিন আগেই বলাৎকারের অভিযোগ ওঠে পাঁচলাইশ এলাকার রহমানিয়া তাহফিজুল কোরআন বালক-বালিকা একাডেমির এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। গ্রেফতার করা হয় নাজিম উদ্দীন নামের ওই শিক্ষককে। তারও কয়েকমাস আগে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল চট্টগ্রামের অক্সিজেন এলাকার আল ইসলামিয়া মাদরাসা থেকে হাবিবুর রহমান নামের ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। তখন পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছিলেন নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করা হয়েছে। পরে ওই ঘটনায় পাঁচজন মাদরাসাশিক্ষকও গ্রেফতার হয়েছিলেন। চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের নানা স্থানে প্রায়ই শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ উঠে আসছে গণমাধ্যমে।

কেএম/এইচকে 

Link copied