শিক্ষায় ‘বিষ’ থাকবে কি একুশে?

শিক্ষার ক্ষতি ও নতুন বছরে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে বিশিষ্টদের ভাবনা
>> শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানো ও ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ
>> অনেক শিক্ষার্থী কাজে ঢুকে গেছে
>> শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ও সাপ্তাহিক ছুটি কমানোর পরামর্শ
>> শ্রেণি, পরীক্ষা ও শিখন পদ্ধতিতে গতি বাড়াতে হবে
মার্চে তিনজনের শরীরের মধ্য দিয়ে দেশে প্রবেশ ঘটে করোনাভাইরাসের। এর ঠিক ১০ দিন পর ভাইরাসটিতে প্রথম প্রাণহানি ঘটে। ধীরে ধীরে এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। ভাইরাসটি কেড়ে নিয়েছে সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি প্রাণ। তবে শুধু মানুষের দেহে নয়, দ্রুতই এ ভাইরাসের বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে সব খাতে। ভীতির সঞ্চার করে প্রতিটি প্রাণে। প্রবল ধাক্কা দেয় অর্থনীতি, শিক্ষা, ব্যবসা, কৃষিসহ প্রতিটি মানুষের দৈনিক ক্রিয়াকর্মে। ব্যাঘাত ঘটে জনজীবনে। স্বাভাবিকতা হারায় হাজার বছর ধরে পালন করে আসা মানুষের সামাজিক কর্মকাণ্ড।
মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারের সিদ্ধান্তে বন্ধ করা হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যতীত সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি। তালা লাগে স্কুল, কলেজসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজায়। বন্ধ করে দেয়া হয় গণপরিবহনের ইঞ্জিনও। জারি করা হয় লকডাউন। নিরুৎসাহিত করা হয় যেকোনো ধরনের জনসমাগমসহ সামাজিক মেলামেশায়। তবে সময়ের পরিক্রমায় জীবন ও জীবিকার তাগিদে ফিরতে হয় স্বাভাবিকতায়। ধীরে ধীরে খোলা হয় সরকারি-বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উঠিয়ে নেয়া হয় লকডাউন। সড়কে ফের নামে গণপরিবহন। তবে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে খোলা হয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
১৭ মার্চ থেকে অদ্যাবধি বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইন, টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার প্রয়াস দৃষ্টিগোচর হলেও এতে মফস্বল ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। হয়নি কোনো পরীক্ষা। কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করা হয় শিক্ষার্থীদের। অটোপাস ঘোষণা করা হয় এইচএসসি, জেএসসি, পিইসিসহ সমমানের পরীক্ষায়। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত হলেও আদতে পুস্তকীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানার্জন হয়নি। বলা চলে, করোনার ‘বিষে’ সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত।
তবে বদলেছে বছর, বিশ থেকে একুশ হয়েছে ক্যালেন্ডারের পাতায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার ভ্যাকসিনও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এতে এ ‘মহামারি কেটে যাবে’ বলে নতুন আশার সঞ্চার হচ্ছে প্রতিটি প্রাণে। যদিও স্মৃতির পাতায় ইতিহাস হয়ে থাকবে ২০২০ সালের ফেলে আসা দিনগুলো। কিন্তু মানুষের মনে শঙ্কা জেগেছে ২০২০ এর মতো শিক্ষাখাতে করোনার বিষ কি থাকবে নতুন বছরেও? তবে আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার হিসাব চুকিয়ে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি ফের নবযাত্রায় শিক্ষাজীবন শুরু করবে এমন প্রত্যাশা সবার।
নতুন বছর ও করোনা পরবর্তী সময়ে কেমন যাবে শিক্ষাখাত? এ নিয়ে কথা হয় দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদদের সঙ্গে। নতুন বছরে শিক্ষাখাতে নানা চ্যালেঞ্জ ও আশার বাণী শুনিয়েছেন তারা। পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো নতুন বছরে শিক্ষা বিষয়ে এসব শিক্ষাবিদদের ভাবনা...
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘করোনা পরবর্তী যে কয়টি খাত সুদূরপ্রসারী ক্ষতির মুখে পড়বে এর মধ্যে অন্যতম শিক্ষাখাত। শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানো হবেই আগামী বছরের প্রথম চ্যালেঞ্জ। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ইতোমধ্যে কিছু পরিকল্পনার কথা বলছেন, সেদিকে সবার নজর থাকবে।’
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ফের স্কুলে নিয়ে আসা। অনেক শিক্ষার্থী কাজের মধ্যে ঢুকে গেছে। দরিদ্রতার কারণে প্রতি বছর বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। মহামারির কারণে প্রায় এক বছর (সাড়ে আট মাস) বন্ধ থাকার পর দরিদ্র শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনাই হবেই আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষকদের কাজে লাগাতে হবে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
এ শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘করোনা পরবর্তী সময়ে রিকভারি (পুনরুদ্ধার) করতে অনেক প্রকল্প আসবে। এগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারের মনিটরিং (নজরদারি) বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার প্রকল্পগুলোকে সরকার অগ্রাধিকার দিতে পারে।’
এ কে আজাদ চৌধুরী
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি (ইউজিসি) কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘করোনায় শিক্ষার ঘাটতি ও বৈষম্য আরও বাড়বে। প্রায় একটি বছর বছর যেহেতু অনলাইন, টেলিভিশনসহ বিকল্প পদ্ধতিতে পাঠদান হলেও মফস্বলের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এর বাইরে থেকেছে; তাই গ্রাম ও শহরের শিশুদের মধ্যে শিক্ষার বৈষম্য আরও বাড়বে।’
এদিকে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ সময় যে দুর্বলতা তৈরি হয়েছে তা ভবিষ্যতে প্রকট রূপ ধারণ করতে পারে। করোনার পরে দরিদ্র কিন্তু মেধাবী এমন শিক্ষার্থীদের কী হবে? তা এখনও আমাদের অজানা। ধারণা করা হচ্ছে, করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঝরে পড়ে যেতে পারে। তাই সরকারকে এদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
এ কে আজাদ চৌধুরী
ইউজিসির সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খোলা সম্ভব হবে? তা এখনও পরিষ্কার নয়। করোনাভাইরাস হয়তো থেকে যাবে। টিকা এলেও কতজন শিক্ষার্থী সেটি পাবে? তাও অনিশ্চিত। তাই যখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে তার আগেই শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে জানিয়ে দেয়া হোক।’
এ শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য হয়তো আলাদা স্বাস্থ্যবিধি তৈরি করতে হবে। কারণ শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যবিধি মানানোটা কঠিন। আমি মনে করি, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আর মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক থাকা প্রয়োজন। এটা নিশ্চিত করা গেলে ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। টিকা দেয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে সরকার গাইডলাইন তৈরি করতে পারে। কেন্দ্রীয়ভাবে গাইডলাইন হতে পারে। কিন্তু স্কুল খোলার পরিকল্পনা করতে হবে স্কুলভিত্তিক।’
রাশেদা কে চৌধুরী
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘করোনা পরবর্তী সময়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে স্কুলে শিক্ষার্থীদের ফেরানো এবং ধরে রাখা। কারণ প্রায় এক বছর বন্ধ থাকার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের জীবন ও আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগসূত্র করে দিতে হবে শিক্ষক-অভিভাবকদের।’
তিনি বলেন, ‘এখনই করোনা পরবর্তী শিক্ষার ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি ঝরে পড়ার শঙ্কা আছে এমন শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া উচিৎ। করোনার মধ্যে স্কুল-কলেজে উপস্থিত না হয়েও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ক্লাসের পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষা পর্যন্ত হয়েছে। এটা নতুন একটি সম্ভাবনা। এটাকে করোনা পরবর্তী সময়ে অব্যাহত রাখতে হবে।’
করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষায় প্রশাসনিক পরিবর্তন আনতে হবে। শ্রেণি, পরীক্ষা শিখন পদ্ধতিতে গতি বাড়াতে হবে। সম্ভব হলে ঐচ্ছিক ছুটি কমিয়ে এনে ক্লাসের সময় ও সংখ্যা বাড়াতে হবে। করোনাকালীন ক্ষতি পোষাতে সবাইকে নিজ দায়িত্বে কিছু কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক-অভিভাবকরা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
রাশেদা কে চৌধুরী
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপচার্য ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) চেয়ারম্যান আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘করোনাকালীন শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে সরকারকে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। বার্ষিক ও সাপ্তাহিক ছুটির সংখ্যা কমিয়ে ক্লাসের সংখ্যা ও সময় বাড়াতে হবে। ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে।’
নতুন বছরের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে- করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তা উত্তরণে বিভিন্ন মেয়াদি ব্যবস্থা নেয়া। এর মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন তা আপৎকালীন ব্যবস্থা। সরকারকে স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
ঢাবির সাবেক এ উপাচার্য আরও বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে করণীয় ঠিক করতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি করতে পারে। কমিটি প্রথমে করোনাকালীন যে ক্ষতি হয়েছে তা চিহ্নিত করবে এবং সরকারের কাছে প্রস্তাব করবে। সরকার সেগুলো পর্যালোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে পারবে।’
এনএম/এফআর