সফলতা মানেই ‘জিপিএ-৫’ নয়

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এবার গড় পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশ। ২০২৪ সালের তুলনায় পাসের হার কমেছে ১৪.৯৫ শতাংশ। এ বছর পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৯ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন শিক্ষার্থী। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি ১০০ জনে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭ জন শিক্ষার্থী। বাকি ৯৩ জন পাননি। তাদের মধ্যেও অনেকে হয়তো জিপিএ-৫ পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করছিলেন। এখন আশানুরূপ ফলাফল না হওয়ায় তারা হয়তো ভাবছেন— ‘এখন আমার কী হবে?’
বাংলাদেশে বোর্ড পরীক্ষার ফল মানেই অনেকে ধরে নেয় সম্মান, সামাজিক অবস্থান আর ভবিষ্যৎ- যেন জীবনের সবকিছু! আর এই পরীক্ষার ফল খারাপ হলে শুধু শিক্ষার্থী নয়, পুরো পরিবারও যেন মুখ লুকাতে চায়!
আরও পড়ুন
এমন বাস্তবতায় গত বছর ফল প্রকাশের মাত্র ৮ ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীকে বিদায় জানায় ৯ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ৬ জনই ছিল মেয়ে।পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর আত্মহত্যার হার বেড়েই চলেছে— বিশেষ করে কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কাজেই, এ বছরের ফলাফলের পরও এমন শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, কিশোর-কিশোরীরা আবেগপ্রবণ হয়। তারা যেমন প্রশংসায় আনন্দিত হয়, অল্প কথায় কষ্টও পায়। তাদের ওপর যখন পরিবার, সমাজ এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও ‘জিপিএ-৫’ পাওয়ার চাপ আসে, তখন ফল খারাপ হওয়া মানে তাদের কাছে ‘ব্যর্থতা’— যার পরিণতি নেতিবাচক কিছুর দিকে ধাবিত হওয়া!
এর পেছনে দায়ী আরও কিছু ব্যাপার আছে, যেমন— বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রত্যাশা, প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের তুলনা, পরীক্ষায় ফেল করলে পরিবার থেকে অবহেলা বা কটূকথা। ইদানীং নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক মাধ্যমের চাপ। ফেসবুকে রেজাল্ট নিয়ে কে কী লিখল!

আরও পড়ুন
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষার্থীরা গুরুতর চিন্তা যখন মাথায় আনে, তখন তাদের মধ্যে নানা ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। যা সচেতন অভিভাবকদের নজরে রাখা উচিত। যেমন, ফলাফল নিয়ে কথা প্রসঙ্গে আত্মহত্যা বা মৃত্যুর কথা মুখে আনা, একা থাকতে চাওয়া, কারও সঙ্গে কথা না বলা, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ সংগ্রহের চেষ্টা, খাবার ও ঘুমে অনিয়ম, এমনকি মেজাজ হারিয়ে ফেলার মতো লক্ষণ দেখা যায়।
শিক্ষার্থীদের এমন মানসিক পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে পরিবার কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন- সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা, ফলাফলের জন্য চাপে না ফেলে ভালোবাসা ও আশ্বাস দেওয়া, রেজাল্ট যাই হোক পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও চাইলে এখানে ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন- প্রতিটি স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিং সেবা চালু করা, ফল খারাপ করা শিক্ষার্থীদের বিশেষ নজরে রাখা, প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া, ফেল মানেই ‘ব্যর্থ’ নয়— এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া।
সফলতা মানেই জিপিএ-৫ নয়
আমরা একটা পরীক্ষার ফলাফল দেখে নিজের সামর্থ্য, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ— সবকিছু নিয়ে সন্দেহ ও উদ্বেগে পড়ে যাই। খারাপ ফলাফল হলেই ধরে নিই আমরা ব্যর্থ, অযোগ্য। কিন্তু একটা পরীক্ষাই কি জীবনের সব? সামনে কি সফল হওয়ার মতো আর সুযোগ নেই? আছে। বিল গেটসের মতো একজন মানুষ— যিনি পৃথিবীর অন্যতম সফল উদ্যোক্তা, একজন ধনকুবের— তাকেও জীবনে বহু পরীক্ষায় বসতে হয়েছে। কখনো সফল হয়েছেন কখনো আবার ব্যর্থও হয়েছেন। উইনস্টন চার্চিল, যিনি যুদ্ধের সময় ব্রিটেনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনিও জীবনে বহুবার ব্যর্থ হয়েছেন।
অতএব জীবনে সফল হওয়ার বহু সুযোগ থাকে। একবার জিপিএ-৫ না পেলে জীবন ব্যর্থ হয়ে যায় না। সামনে জিপিএ-৫ পাওয়া কিংবা জীবনের অন্যান্য ধাপে আরও সফল হওয়ার বহু সুযোগ আসবে। সেসব সুযোগের জন্য নিজেকে নতুন করে তৈরি করতে হবে।
এমন বহু উদাহরণ আছে, প্রথম জীবনে ব্যর্থ বা কম সফল মানুষেরা পরবর্তী জীবনে অনেক বড় সাফল্য অর্জন করেছেন। যেমন- প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন ছিলেন স্কুলের মাঝারি মানের ছাত্র; স্টিভ জবসকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল; আইনস্টাইন, যাকে আমরা বিজ্ঞানের অন্যতম আলো, প্রতীক বলে জানি, তাকেও প্রাথমিক স্কুলে ‘স্লো লার্নার’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল; আর পাশের দেশ, ভারতের ‘মিসাইল ম্যান’ খ্যাত এপিজে আবদুল কালাম— তিনিও পরীক্ষায় খারাপ ফল করেছিলেন।
এসব মনীষীদের প্রায় সবাই পরীক্ষায় এক বা একাধিকবার খারাপ করেছেন। কিন্তু জীবন তাদের থামিয়ে রাখতে পারেনি। এরা সবাই পরবর্তী জীবনে বিখ্যাত হয়েছেন। কারণ, তারা বিশ্বাস করতেন, শুধু পরীক্ষার নম্বর তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসন বলেছিলেন, ‘আগামীকাল আমার পরীক্ষা, কিন্তু আমি তাতে কিছু মনে করি না। কারণ, একটি মাত্র কাগজ আমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে না।’ কাজেই কখনো ব্যর্থতা আসা মানেই সব শেষ তা নয়— বরং কখনো কখনো ব্যর্থতা মানে নতুন শুরুর সুযোগ। আমাদের শিক্ষার্থীরা যারা জিপিএ-৫ পাননি বা যারা কোনো কারণে অকৃতকার্য হয়েছেন তারা নতুন করে শুরু করুন। সাফল্যের জন্য জীবন ও সময় দুটোই পড়ে আছে আপনাদের সামনে। কোনো কিছুই শেষ হয়ে যায়নি; একটি পরীক্ষার ফলাফলে কোনো কিছু শেষ হয়ে যায় না।