চিরকালীন রবীন্দ্রসংগীত

আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। এমন দিনে কবি গুরুকে স্মরণ করে লিখেছেন দেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার সভাপতি তপন মাহমুদ
আজ এক অস্থির সময় আমরা অতিক্রম করছি। সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রলয়ংকরী মহামারির পাশাপশি যে অস্থিরতা বিরাজমান তা থেকে আমাদের দেশ বা সংস্কৃতি অঙ্গনও নিষ্কৃতি পায়নি। চর্তুদিকে সুরের নামে অসুরের তাণ্ডব চলছে। এ প্রসঙ্গে আজ থেকে ১০৩ বছর আগে ১৩২৪ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ তার সংগীতের মুক্তি প্রবন্ধে লিখেছিলেন-
‘আজ নূতন যুগের সোনার কাঠি আমাদের অলস মনকে ছুঁইয়াছে। কেবল ভোগে আর তৃপ্তি নাই, আমাদের আত্মপ্রকাশ চাই। সাহিত্যে তার পরিচয় পাইতেছি। স্পষ্টই দেখিতেছি আমরা পৌরণিক যুগের বেড়ার বাহিরে আসিলাম। আমাদের সামনে এখন জীবনের বিচিত্র পথ উদঘাটিত। এখন আমাদের সংগীতও যদি এই বিশ্বযাত্রার তালে তাল রাখিয়া না চলে তবে ওর উদ্ধার নাই। এই যে আমাদের নূতন জীবনের চাঞ্চল্য, গানের মধ্যে ইহার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা দিয়াছে। আজকাল ঘরে ঘরে হারমনিয়াম, গ্রামোফোন, পাড়ায় পাড়ায় কনসার্ট। ইহাতে অনেকটা রুচি বিকার দেখা যায়। কিন্তু চিনি জাল দিবার সময় গোড়ার বলকে, রসে অনেকটা পরিমাণ গাদ ভাসিয়া ওঠে। সেই গাদ কাটিতে কাটিতেই রস ক্রমে গাঢ় ও নির্মল হইয়া আসে। আজ টগবগ শব্দে সংগীতের সেই গাদ ফুটিতেছে, পাড়ায় টেকা দায়। কিন্তু সেটা লইয়া উদবিগ্ন হইবার দরকার নাই। সুখবরটা এই যে, চিনির জ্বাল চড়ানো হইয়াছে।’ ১৩২৪ সালে লেখা কথাগুলো আজ ১৪২৭ বঙ্গাব্দেও (২০২১খ্রিষ্টাব্দেও) আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে সমভাবে প্রযোজ্য।
‘গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভূবন খানি, তখন তারে চিনি, আমি তখন তারে জানি’-এই যে গানের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তার চিরচেনা ভূবনকে দেখতে চেয়েছিলেন এবং পেয়েছিলেন তার কারণ সমগ্র রচনার মধ্যে তিনি তার গানকেই সম্ভবতঃ শ্রেষ্ঠ আসন দিয়েছিলেন। কবিতায় যখন তার পরম প্রিয়তম এর সান্নিধ্যে লাভ প্রশ্নবোধক থাকে, তখন গানে এসে তিনি কিন্তু পরম প্রিয়তম'র নিশ্চিত সান্নিধ্য লাভ করার কথা বলতে কোনো দ্বিধা করেননি। যেমন কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘ওহে অন্তরতম, মিটেছে কি তব সকল পিয়াস, আসি অন্তরে মম।’ কিন্তু গানে তিনি নিশ্চিত হয়ে বলেন, ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর, তুমি তাই এসেছ নিচে।’
রবীন্দ্রনাথ তার সমস্ত সংগীত সৃষ্টিকে প্রেম, প্রকৃতি ও পূজা প্রভৃতি নানান পর্যায়ে ভাগ করলেও তার প্রায় সব গানকেই আত্মনিবেদনের গান বললে অত্যুক্তি হয় না। তার গানে প্রেমের মধ্যেও অরূপের অনুভূতি, প্রকৃতির মধ্যেও তাই। আমাদের বাঙালি জীবনের যত দিক আছে, যত রকম অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা আছে, রবীন্দ্রনাথের গানে তার প্রায় প্রত্যেকটির প্রতিফলন রয়েছে। তাই আমাদের মন সব অবস্থায় আশ্রয় পায় তার গানে। জীবনকে গানের মধ্যে দিয়ে এমন করে উপলব্ধি করার অভিজ্ঞতা সম্ভবত আর কোনো রচয়িতার গানে অনুভব করা যায় না।
লেখক : রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, সভাপতি-বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা
আরআইজে