মঞ্চের বীরপুত্র আলী যাকের

বহুব্রীহির মামা তখনও আমাদের কাছে ‘ছটলু’ ভাই হয়ে উঠেন নাই। ‘নাগরিক’-এ সবেমাত্র যুক্ত হয়েছি। ‘নাগরিক’ মানে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। বাংলাদেশের অন্যতম প্রথম সারির নাট্যদল। নতুন সদস্যদের দলে যোগদান উপলক্ষ্যে সবাইকে ডাকা হয়েছে। মহড়াকক্ষ জুড়ে তারকার মেলা। আলী যাকের, আতাউর রহমান, আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, খালেদ খান, নীমা রহমান, লুৎফর রহমান জর্জ, নাসিরুল হক খোকন, বিপাশা হায়ত, আফসানা মিমি, টনি ডায়েস, নুনা আফরোজ, কাজী রুমা, অনন্ত হীরা, গাজী রাকায়েত আরও অনেকে।
সবাই সিনিয়র আমরা নতুন সদস্য। তাই হা-করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নাই। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে একজন মহড়া কক্ষে ঢুকলেন। সঙ্গে সঙ্গে টানটানি পড়ে গেল। একজন বললেন, মীরু আমার কাছে দাও। আরেকজন বললেন, না না মীরু আমার কাছে দাও। তখনই দেখলাম রুমের অন্য মাথা থেকে সিনিয়রদের একটা টিম ‘হিস হিস’ শব্দ করতে লাগল। হিসসসসসস...।

দেখাগেল এখন আর কেউ বাচ্চাটাকে কোলে নিতে চাচ্ছে না। একজন বলে, নাও নাও তুমি নাও। আরেকজন বলে, না না তুমি নাও। ঠিক সেই সময় আবুল হায়াত দাড়িয়ে গেলেন, ‘তোমরা এমন হিস হিস করছ কেন আমার সমস্যা হচ্ছে’। বলেই তিনি টয়লেটের দিকে চলে গেলেন।
আরও পড়ুন : আলী যাকের : আলোর বাতিঘর
মুচকি হেসে সবার সামনে দাঁড়ালেন আলী যাকের। বললেন ‘দুষ্টুমি বন্ধ কর, কাজের কথায় আস। দক্ষিণ এশিয় নাট্যোৎসবে আমাদের শ্লোগান হবে- ‘যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে মুক্ত হে বন্ধ’। তারপর আবার মজা করে বললেন, শব্দটা কিন্তু বন্ধু নয়, বন্ধ।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কি চমৎকার একটা দল! কি চমৎকার তাঁদের পরিবেশ! কি চমৎকার তাঁদের বোঝাপড়া! কি চমৎকার সৃষ্টিশীলতা! এরা তো দূর আকাশের তারকা নন, মাটির মানুষ। আমার নাগরিকের যাত্রা শুরু হল। ভুল ভাঙল, সবার আগমনের উদ্দেশ্য আমরা নই, নাট্যোৎসব।

চোখের সামনে দেখলাম, পুরো দেশ কাপিয়ে একটা নাট্যোৎসব হল। বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকগুলো নাট্যদল এলো। শিল্পকলা একাডেমির পুরো মিলনায়তন পূর্ণ করে বাইরে পর্যন্ত মানুষের সারি। নাগরিক-এর শক্তি সম্পর্কে একটু ধারণা হলো। সাধারণ মজা করা থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত নাগরিকের শক্তির পরিচয় পেলাম। একটা সময় লক্ষ্য করালাম আলী যাকের এখন আর আলী যাকের নন, তিনি এখন আমাদের ছটলু ভাই।
দলের প্রতিটি মানুষের কাছে অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ এই ছটলু ভাই। একই সঙ্গে তিনি নির্দেশক, সহ-অভিনেতা, বড় ভাই। আবার একই সঙ্গে শিক্ষাগুরু। ছটলু ভাইয়ের সঙ্গে কোনো নাটকের মহড়া মানে শুধু মহড়া নয় এক একটা ক্লাস, সেমিনার, শিক্ষামূলক আড্ডা। হোক সে নূরলদীনের সারা জীবন, দেওয়ান গাজীর কিসসা, গ্যালিওি কিংবা অচলায়তন।
প্রচণ্ড টেকনোলজি প্রিয় একজন মানুষ এই ছটলু ভাই। নতুন কোন মডেলের ক্যামেরা বাজারে এলো, কোন ডিভাইসের এপ্লিকেশন কী সব কিছু আমরা জানতাম ছটলু ভাইয়ের কাছ থেকে। প্রতিটি বিষয়ে তাঁর সে কি উচ্ছাস। আবার সেই নরম-কোমল মানুষটি যখন মঞ্চে উঠে দাঁড়ান তখন তিনি হয়ে ওঠেন বিশাল, অপ্রতিদ্বন্দী এক বীরপুত্র।

একটা ঘটনা বলি। একদিন জানানো হল আবার ‘নূরুলদীনের সারা জীবন’ নাটকটার প্রদর্শনী করা হবে। কোথায় করা হবে? মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে। তখন মুক্তিযদ্ধ যাদুঘর ছিল বিজয় নগরে, প্রেসক্লাবের উল্টোপাশের একটা গলিতে। আমরা তো স্তব্ধ। বলে কি! দশ-ফুট বাই বার-ফুট একটা মঞ্চে কীভাবে ‘নূরুলদীনের সারা জীবন’ করা সম্ভব?
আলী যাকের সবাইকে ডাকলেন, নতুন করে ডিজাইন করলেন, মহড়া করলেন। তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের পর নাটকের প্রদর্শনী হল। নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হল। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের মূল মঞ্চ ব্যবহার না করে খোলা আকাশের নিচে এমনভাবে তিনি নাটকটির নির্দেশনা দিলেন সবাই সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। এই হলেন আলী যাকের। আমাদের ছটলু ভাই। একজন স্বপ্নবাজ মানুষ।
বাংলাদেশে টিকিটের বিনিময়ে মঞ্চ নাটকের প্রদর্শনী এই মানুষটার স্বপ্ন, যাত্রার ঢং থেকে বের করে জীবনের কাছাকাছি এনে মঞ্চনাটক উপস্থাপন করা-এই মানুষটার স্বপ্ন। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতে নতুন নতুন উপস্থাপনা-এই মানুষটার স্বপ্ন। যার মধ্যে যে গুণ আছে সেটাকে সেভাবেই কাজে লাগাতে জানতেন আলী যাকের। মনে করুন একটা মানুষ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। আলী যাকের তাকে নিয়ে এমনভাবে একটা চরিত্র তৈরি করতেন দেখে মনে হত, চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে লোকটা কত কষ্ট করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছেন।
অভিনয়ের বাইরেও ছটলু ভাইয়ের আশেপাশে থাকতেই আমাদের বেশি ভাল লাগত। যেকোনো ধরনের নতুন তথ্য আমরা তাঁর কাছে পেতাম। তিনি যেমন গল্প করতেন, তেমন আবৃত্তি করতেন, তেমন পাঠ করতেন। তখন আমি ভোরের কাগজের সাব-এডিটর। নাগরিকের বাইরের একজন হয়ে আলী যাকের এর স্বাক্ষাৎকার নিতে হাজির হয়েছি এশিয়াটিকের তিন তলায়।
এশিয়াটিক তখন বেইলি রোডে ছিল। কি চমৎকার একটা চিলেকোঠা। বিশাল জানালা, বাইরে একটা নারকেল গাছ দোল খাচ্ছে। জানালা দিয়ে নওরতন কলোনির বিশাল পুকুরটা দেখা যাচ্ছে। আমি মুগ্ধ হয়ে এসব দেখছি দেখে তিনি বললনে, রুমটা সুন্দর না? বলেই টেবিলে রাখা বই থেকে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা লাইন পাঠ করে শোনালেন। লম্বা সময় ধরে স্বাক্ষাৎকার নিয়ে শেষ করলাম। হঠাৎ বললেন, ‘ছটলু’ শব্দটা বারবার না লেখাই বোধহয় ভালো।
আমি বললাম, ‘ছটলু’ শব্দটা হাজার বার লিখলেও সমস্যা নাই ছটলু ভাই। আপনার যা ব্যাক্তিত্ব ‘ছটলু’ শব্দের সেই সামর্থ নাই সেটা ধারণ করে। এর জন্য ‘আলী যাকের’ দরকার। হো হো করে হেসে উঠলেন আলী যাকের। হাতের সুন্দর কলমটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নাও এটা তোমার।

আলী যাকের এখন আর নাই। কিন্তু কলমটা আমার কাছে আজো আছে। অত্যন্ত যত্নে আছে। কারণ সেটা `আলী যাকের’-এর দেওয়া উপহার। আমাদের ছটলু ভাইয়ের দেওয়া উপহার।
গ্যালিলিও নাটকের একটা জায়গায় আন্দ্রেয়া, গ্যালিলিওকে বলে, অভাগা সে দেশ যার বীর পূত্র নাই। সঙ্গে সঙ্গে গ্যালিলিও বলেন, না আন্দ্রেয়া, ভুল বললে। অভাগা সে দেশ যার বীরপুত্রের প্রয়োজন। এখন বড়ই অভাগা আমরা। একজন আলী যাকের-এর খুব প্রয়োজন আমাদের। বীরপুত্র আলী যাকের। দেশ এবং নাগরিক এই শুন্যতা বয়ে বেড়াবে আজীবন।
লেখক:
সাংবাদিক ও অভিনেতা
এমআরএম