কষ্টার্জিত শেষ সম্বলও হাতিয়ে নিয়েছেন জাপার জয়!
মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে একাধিক প্রতারক প্রতিষ্ঠান। ডেসটিনি, যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক) বা ইউনিপে টু ইউ’র মতো প্রতারক প্রতিষ্ঠানের পর এবার অভিযোগ উঠেছে ‘মেগাসাইট স্যাটেলাইট সিটি’ নামের কোম্পানির বিরুদ্ধে। দারুণ মুনাফার অফার দিয়ে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কোম্পানিটি। অভিযোগ উঠেছে, এ কোম্পানির সঙ্গে জড়িত স্বয়ং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা হাসিবুল ইসলাম জয়।
তার কথায় বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন বলে যারা দাবি করছেন তাদের একজন সিমা আক্তার। হাসিবুল ইসলাম জয়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৪ জুলাই তিনি মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর গত ১৩ জানুয়ারি ঘটনার সত্যতা পেয়ে তদন্ত কর্মকর্তা মো. ফারুক হোসেন প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এক লাখে মাসে ছয় হাজার টাকা লভ্যাংশ এবং ১৬ মাস পর মূল টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু দু-এক মাস লভ্যাংশ দিলেও এরপর তারা আর টাকা দেয়নি। এখন আমরা সব বিনিয়োগকারীই মানবেতর জীবন-যাপন করছি
মামলার বাদী ও ভুক্তভোগী সিমা আক্তার
সিমা আক্তারের দায়ের করা মামলায় হাসিবুল ইসলাম জয়সহ আসামি ১৪ জন। মামলার অপর আসামিরা হলেন- মো. আব্দুর রহমান দাড়িয়া, মো. রেজাউল করিম, পিংকি আক্তার, মো. জাকির হোসেন, মো. ফয়েজ নুরী, মো. এমদাদুল হক, মো. জালাল উদ্দিন, মো. বিল্লাল, মো. সাঈদ, মো. সুমন, মো. সালাহউদ্দিন আহমেদ ও সালেহ আহমেদ।
মামলা সূত্রে জানা যায়, মেগাসাইট স্যাটেলাইট সিটি কোম্পানি দারুণ মুনাফার অফার দিতে থাকে বিনিয়োগকারীদের জন্য। বিনিয়োগকারীরাও হামলে পড়েন তাতে। হাসিবুল ইসলাম জয়ের কথায় কেউ জমানো টাকা, কেউ অবসরের পর পাওয়া টাকা, কেউ-বা ধার করে বিনিয়োগ করেছেন লাখ লাখ টাকা।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য দারুণ মুনাফার অফার দেয় মেগাসাইট স্যাটেলাইট সিটি কোম্পানি। সেখানে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতি মাসে ছয় হাজার টাকা লভ্যাংশ পাওয়া যাবে বলে বলা হয়। এখানেই শেষ নয়। টোপের বড়শিতে দেওয়া হয় আরও লোভনীয় অফার। বলা হয়, বিনিয়োগের ১৬ মাস পর মূলধন ফেরত দেওয়া হবে পুরোটাই। কোম্পানির এমডি পরিচয়ে হাসিবুল ইসলাম জয় বলেন, ‘আপনারা নির্ভয়ে মেগাসিটিতে বিনিয়োগ করেন। আপনাদের বিনিয়োগ করা টাকার জিম্মাদার আমি।’
তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে বলেন, যদি তিনি কোম্পানিটির কেউ না হন, তাহলে কেন তিনি সিকিউরিটি হিসেবে ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেক প্রদান করেছেন?
তার এমন প্রতিশ্রুতিতে অধিক মুনাফার লোভে যারাই বিনিয়োগ করেছেন, তারাই গেছেন ফেঁসে। দু-এক কিস্তি লাভের টাকা তারা পান। কিন্তু তারপর আর খোঁজ নেই। মূলধন ওঠাতে অফিসে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, চম্পট দিয়েছে মেগাসাইট স্যাটেলাইট সিটি কোম্পানিটি। এতে পথে বসেছেন শত শত লোক।
প্রতারিত বিনিয়োগকারী সিমা আক্তার নিরুপায় হয়ে দ্বারস্থ হন আদালতের। দায়ের করেন একাধিক মামলা। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে, বনানী ১৯নং রোডের ২২ নম্বর বাড়িতে মেগাসাইট স্যাটেলাইট সিটি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অফিস খোলা হয়। বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন আকর্ষণীয় অফার দেওয়া হয়। মেগাসাইট স্যাটেলাইট সিটির এমডি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন হাসিবুল ইসলাম জয়।
ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা জানান, হাসিবুল ইসলাম জয় বিনিয়োগকারীদের অনুরোধ করেন যাতে তার কথা গোপন রাখা হয়। এমনকি তার কোনো ছবি ও ভিডিও করতেও মানা করা হয়। কারণ, তিনি একজন রাজনীতিবিদ। তাই এতে কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এছাড়া কোম্পানির মালিক হিসেবে তার পরিচয় প্রকাশ পেলে ‘তার ব্যক্তিগত সমস্যা হবে’— এমন কথায় বিশ্বাস করে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ অনেক সাধারণ মানুষ কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ করেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
এদিকে পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামলার আসামি হাসিবুল ইসলাম জয় জানিয়েছেন- তিনি মেগা স্যাটেলাইটের কেউ না। কোম্পানির কোথাও তার কোনো নাম নেই।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোম্পানিতে হাসিবুল ইসলাম জয়ের নাম নেই, এটা সত্য। তবে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কোম্পানির এমডি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, এটাও সত্য। বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন গ্রাহককে হাসিবুল ইসলাম জয় ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেক সিকিউরিটি হিসেবে দিয়েছেন বলে তদন্তে জানা গেছে।
তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে বলেন, যদি তিনি কোম্পানিটির কেউ না হন, তাহলে কেন তিনি সিকিউরিটি হিসেবে ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেক প্রদান করেছেন?
তদন্তে জানা যায়, প্রতারক কোম্পানিটির কোনো অনুমোদন ছিল না। তবে হাসিবুল ইসলাম জয় ও অন্যান্য আসামিরা বিভিন্নভাবে এ কোম্পানির মাধ্যমে প্রতারণা করেছেন। এর মাধ্যমে গ্রাহকদের বিভিন্ন অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা।
এখন লাভ বা মূলধন কোনোটাই পাচ্ছি না। আমার মতো হাজার হাজার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন
ভুক্তভোগী নূর মোহাম্মদ
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ভুক্তভোগী সিমা আক্তার বিনিয়োগের টাকা ও লভ্যাংশ না পেয়ে অফিসে যোগাযোগ করতে যান। গিয়ে দেখেন অফিস বন্ধ। সবাই পালিয়েছেন। প্রতারকরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। মেগাসাইট স্যাটেলাইট সিটি তাদের নামমাত্র প্রকল্প। অধিক লোভের আশায় এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করে শত শত ক্ষতিগ্রস্ত অবসরপ্রাপ্ত আর্মি, বিমান, নৌবাহিনী ও পুলিশ অফিসারসহ অন্যান্য পেশাজীবী নিঃস্ব হয়েছেন। বাদী সিমা আক্তার খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়ে যান যে, তিনি প্রতারণার শিকার।
গত ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর ৪১ লাখ ৮০ হাজার পাওনা টাকা ফেরত চাইলে আসামিরা হুমকি দেন সিমা আক্তারকে। মামলার বাদী সিমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি দর্জিকাজ করি। নিজের জমানো কিছু টাকা ছিল। এর সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আরও কিছু টাকা ধার নিয়ে মোট ৪১ লাখ টাকা মেগাসিটি স্যাটেলাইট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করি। এক লাখে মাসে ছয় হাজার টাকা লভ্যাংশ এবং ১৬ মাস পর মূল টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু দু-এক মাস লভ্যাংশ দিলেও এরপর তারা আর টাকা দেয়নি। এখন আমরা সব বিনিয়োগকারীই মানবেতর জীবন-যাপন করছি।
তিনি আরও বলেন, ‘মামলার ১নং আসামি হাসিবুল ইসলাম জয়। আমরা তার কথা বিশ্বাস করেই আজ পথে বসেছি।’
মেগাসিটি স্যাটেলাইটে বিনিয়োগকারী আরেক ভুক্তভোগী নূর মোহাম্মদ। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘আমিসহ অবসরপ্রাপ্ত আরও অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর প্রাপ্ত টাকা ইনভেস্ট করেছি। এখন লাভ বা মূলধন কোনোটাই পাচ্ছি না। আমার মতো হাজার হাজার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’
কেউ যদি বিনিয়োগের লভ্যাংশ দিয়ে প্লট কিনতে চায় তাহলে সেই সুযোগও রয়েছে। প্রতারক কোম্পানিটি এভাবে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে
সৈয়দ মো. আসলাম, বাদীপক্ষের আইনজীবী
বিনিয়োগকারীরা জানান, হাসিবুল ইসলাম জয় কখনও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের ভাগ্নে আবার কখনও সাবেক গভর্নরের ছেলে বলে বিনিয়োগকারীদের কাছে পরিচয় দিতেন। তার কথায় বিশ্বাস করেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ মো. আসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সিমা আক্তার বাদী হয়ে হাসিবুল ইসলাম জয়সহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন। মেগা স্যাটেলাইট সিটি কোম্পানিটি প্রতি লাখে ছয় হাজার টাকা লাভ দেবে বলেছিল। পরে তাদের বলা হয়েছে, কোম্পানির পূর্বাচলে প্লট রয়েছে। কেউ যদি বিনিয়োগের লভ্যাংশ দিয়ে প্লট কিনতে চায় তাহলে সেই সুযোগও রয়েছে। প্রতারক কোম্পানিটি এভাবে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। প্রতারকদের বিরুদ্ধে বনানী থানায় আরও দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই দুই মামলায় কিছু আসামি গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।’
অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে জাতীয় পার্টির উপদেষ্টা হাসিবুল ইসলাম জয়ের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় কিন্তু তা বন্ধ পাওয়া যায়। জাতীয় পার্টি সূত্রে জানা যায়, দুই মাস ধরে তিনি নিখোঁজ আছেন। দলের কারও সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।
টিএইচ/এইচকে/এমএআর