তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পাচ্ছেন কোরআনের আলো
প্রাচীনকাল থেকেই অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। নেই পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃতি, বঞ্চিত শিক্ষার আলো থেকে। আছে বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও সার্বিক নিরাপত্তার সংকট। বেঁচে থাকতে এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে টাকা তোলা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান-বাজনাসহ নানা কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন তারা। সেগুলোও আবার সমাজে ‘নেতিবাচক’ প্রবণতা হিসেবে দেখা হয়।
সামাজিক বৈষম্য দূর করতে বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষায় নিজেদের আলোকিত করতে গত বছরের ৬ নভেম্বর দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য প্রথম চালু করা হয় ‘দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা’। রাজধানী ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের লোহার ব্রিজ এলাকায় সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে গড়া মাদ্রাসায় ৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে রাজধানীর ১২টি স্থানে গঠিত এমন মাদ্রাসায় দুই শতাধিকের বেশি তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য কোরআন শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন।
অনেকের ধারণা, মাদ্রাসাগুলোতে কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি জীবনধারণের জন্য তাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মানুষের এমন ধারণা ভুল—উল্লেখ করে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা জানান, এখানে শুধু তাদের কোরআন শিক্ষার সুযোগ হয়েছে। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের আগের পথেই হাঁটতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য তারা বলেন, আগে আমরা অর্থ দিয়েও কোরআন শিক্ষার সুযোগ পেতাম না। এখন বিনা খরচে সুযোগ পেয়ে খুশি। এটা আমাদের আখিরাতে কাজে লাগবে।
‘কিন্তু কোরআন শিক্ষা নিতে এসে আমাদের জীবিকার সম্ভাবনা কমছে। আগের চাইতে বেশি বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হচ্ছি। কারণ মানুষের ভুল ধারণা হচ্ছে যে, কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের অর্থসহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখানে আমরা শিক্ষার সুযোগটা পাচ্ছি। আর জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে আগের মতোই, অন্যের কাছ হাত পেতে। এখান থেকে আমাদের কোনো অর্থ দেওয়া হয় না।’
তাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, জীবিকা নির্বাহ করতে হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেচে-গেয়ে, অথবা কারও বাড়িতে নতুন শিশু জন্মালে বকশিশ তুলে, রাস্তায় হেঁটে-হেঁটে দোকানপাট ও মানুষের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে। এগুলো করতে গেলেও তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
অভিযোগের কণ্ঠে তারা আরও বলেন, পত্রিকা ও টেলিভিশনে আমাদের কোরআন শিক্ষার খবর প্রকাশ হওয়ার পর বৈষম্য আরও বেড়েছে। কারণ এখন টাকা তুলতে গেলে মানুষ টাকা না দিয়ে উল্টো বলে, তোমরা কোরআন শিখছ, সেখান থেকে টাকা দেওয়া হচ্ছে, সরকার চাকরি দিচ্ছে; এরপরও কেন রাস্তায় নেমে টাকা তোল? এসব কারণে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা এখন আর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চান না।
তবে সংশ্লিষ্টদের আশা, ধীরে ধীরে মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পারবে। এতে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ কমবে। পরিপূর্ণভাবে শিক্ষাজীবন শেষে করতে পারলে তারা নিজেরাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। তখন আর মানুষের কাছে হাত পাততে হবে না তাদের।
গত ২৮ জানুয়ারি বিশেষ অনুরোধে দয়াগঞ্জ সেন্টারের তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হন। সেখানে মোট ৩০ জনকে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কথা হয় ডায়না ও বিথীর সঙ্গে।
ডায়না বলেন, জীবিকার জন্য যাই করি না কেন, পরের জনমের জন্য তো কিছু করতে হবে। নামাজ-কোরআন শিক্ষার দরকার আছে। সেজন্য আমাদের গুরু-মা এ ব্যবস্থা করেছেন। টাকা দিয়ে কোরআন শিক্ষার কথা বললে কেউ রাজি হত না। ফ্রিতে সে সুযোগ পাচ্ছি।
‘এখন রাস্তায় টাকা কালেকশনে গেলে অনেকে বলে, তোমাদের তো কোরআন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। সহযোগিতা করা হচ্ছে, টাকাও দেওয়া হচ্ছে। সরকার চাকরিও দিচ্ছে। তারপরও কেন তোমরা রাস্তায় আসছ? অনেকে নানা রকম কটূক্তিও করে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এখানে শুধু কোরআন শিক্ষাটাই দেওয়া হচ্ছে, কোনো অর্থ দেওয়া হচ্ছে না।’
বিথী বলেন, সাধারণের মতো আমাদেরও মৌলিক অধিকার আছে। শুধু ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকলেও চলবে না, সবকিছুর দরকার আছে। সরকার আমাদের জন্য আরও ভালো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করুক, যাতে আমরা ভালোভাবে বাঁচতে পারি। এখন অনেকে বলেন, তোমাদের কোরআন শিক্ষা দেয়, খাওয়া-দাওয়া দেয়, টাকা-পয়সা দেয়। তাহলে রাস্তায় টাকা তুলতে আস কেন?
দয়াগঞ্জ সেন্টারের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আবু বক্কর সিদ্দিক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে কেউ-কেউ কোরআন পড়া শুরু করেছে। আমাদের উদ্দেশ্য, এখান থেকে কোরআনে হাফেজ বের করে আনা। তারাও কোরআন-হাদিস জানুক। বলতে গেলে, তারা সবাই মুসলমান। কিন্তু তারা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আমাদের সর্বশেষ লক্ষ্য হচ্ছে, পরিপূর্ণভাবে তাদের ইসলাম সম্পর্কে জানানো ও বোঝানো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর ১২টি সেন্টারে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের বিনামূল্যে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- যাত্রাবাড়ী, দয়াগঞ্জ, সায়েদাবাদ, করাতিটোলা, জুরাইন, মুগদা, ফকিরাপুল, কমলাপুর ও মিরপুর। এসব স্থানে দুই শতাধিক সদস্যকে কোরআন-হাদিস সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আছেন ১৫ জন প্রশিক্ষক (হুজুর)। তাদের বেতন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। কোরআন শিক্ষার পুরো কার্যক্রমের ব্যয় বহন করছে কামরাঙ্গীরচর মরহুম আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশন।
‘দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা’র প্রতিষ্ঠাতাপরিচালক মুফতি মোহাম্মদ আব্দুর রহমান আজাদ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুরুতে আমরা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গিয়ে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের শিক্ষা দিয়ে আসতাম। গত বছরের ৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে দাওয়াতুল কুরআন মাদ্রাসায় তাদের কোরআন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে আমাদের তত্ত্বাবধানে রাজধানীতে ১২টি সেন্টার রয়েছে। ১৫ জন শিক্ষকের অধীনে দুই শতাধিকের বেশি তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যকে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যারা শিক্ষা নিচ্ছে, তাদের কোনো অর্থসহায়তা দেওয়া হয় না। শুধু বিনাখরচে কোরআন শিক্ষাটা দেওয়া হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আব্দুর রহমান আজাদ বলেন, মাদ্রাসাটি চালু হওয়ার পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রচার হয়। তখন রাস্তায় টাকা তুলতে গেলে তাদের কিছুটা বাধার মুখোমুখি হতে হয়। এ কারণে তারা কোনো গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হচ্ছে না। কিন্তু এখন এ সমস্যা কমে আসছে। মানুষও বুঝতে পারছে। আশা করি, ভবিষ্যতে এ সমস্যা থাকবে না।
‘ভবিষ্যতে তাদের মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা আছে’— জানিয়ে মোহাম্মদ আব্দুর রহমান বলেন, ‘এতে তারা আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী হবেন।’
এদিকে, ‘বাংলাদেশ হিজড়া কল্যাণ ফাউন্ডেশন’র ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি স্বপ্না বলেন, আমাদের কাছে যদিও সঠিক সংখ্যা নেই, তারপরও বিভিন্ন হিসাবে প্রায় দুই লাখেরও বেশি তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে আছে আমাদের এমন কোনো সদস্য, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ঢাকা উত্তর সিটির অধীন আমাদের বেশ কয়েকটি বিউটি পার্লার ও গরুর খামার রয়েছে।
কওমি সিলেবাসে মাদ্রাসার শিক্ষাকার্যক্রম
গত বছরের ৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় দেশের প্রথম দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসাটি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি মাদ্রাসাটি সরকারি স্বীকৃত কওমি সিলেবাসে পরিচালিত হচ্ছে। চলতি মাসের শুরুতে মাদ্রাসাটি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নিবন্ধন পেয়েছে।
মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুর রহমান আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৮ ফেব্রুয়ারি কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের নিবন্ধন পেয়েছি। সে অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকও এনে পাঠদান চলছে। বর্তমানে এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩ জন। পরে মাদ্রাসাটি আবাসিক করারও পরিকল্পনা রয়েছে।
তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের শিক্ষাজীবন শেষে মসজিদের ইমাম হওয়া সুযোগ আছে কি-না এবং এ বিষয়ে ইসলামের বিধান কী—জানতে চাইলে মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুর রহমান বলেন, তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ রয়েছেন। পুরুষরা আমাদের মতো সব কাজ করতে পারে। তবে তারা ইমাম হতে পারবে কি-না, এ বিষয়ে ইসলামে বিধান কী, তা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না।
সরকারি হিসাবে দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা ১০ হাজার। তবে, ‘বাংলাদেশ হিজড়া কল্যাণ ফাউন্ডেশন’র তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশ তাদের সংখ্যা লাখ দুই লাখেরও বেশি।
২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচয়কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে এ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুমোদন হয়। পরের বছর ভোটার নিবন্ধন বিধিমালা প্রণয়নের সময় নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন ফরমে লিঙ্গ পরিচয় হিসেবে হিজড়া যুক্ত করে। এরপর থেকে তারা বিভিন্ন নির্বাচনেও অংশ নেন।
এএইচআর/এমএইচএস/এমএআর